মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫
Ad for sale 100 x 870 Position (1)
Position (1)

ট্রাম্পের ‘উড়ন্ত কারাগার’

ধ্রুব নিউজ ডেস্ক ধ্রুব নিউজ ডেস্ক
প্রকাশ : বুধবার, ৮ অক্টোবর,২০২৫, ১০:১৮ পিএম
ট্রাম্পের ‘উড়ন্ত কারাগার’

২০২৫ সালের শুরুর দিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হওয়ার পর থেকে আইসিই (ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট) ব্যাপকভাবে বহিষ্কার কার্যক্রম বাড়িয়েছে। সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ পরিসংখ্যান বলছে, প্রথম ছয় মাসেই প্রায় দেড় লাখ মানুষকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করার পথে রয়েছে তারা।

হাজার হাজার ফুট ওপরে, নীল আকাশের বুকে ছুটছিল একটি বিমান। জানালার বাইরে অসীম আকাশ যেন মুক্তির বিভ্রম তৈরি করছিল। কিন্তু ভেতরে বসে থাকা যাত্রীদের জন্য মুক্তি ছিল কেবল মরীচিকা।

তাদের সামনে ট্রেতে সাজানো খাবার থেকে হালকা বাষ্প উঠছিল। কিন্তু খাবার মুখে তোলা ছিল প্রায় অসম্ভব। কারণ, তাদের কবজি হাতকড়ায় বাঁধা, কোমর ও পা শক্ত শিকলে আটকানো। আসন থেকে ওঠা তো দূরের কথা, সামান্য নড়াচড়া করতেও অন্যের সাহায্যের প্রয়োজন হচ্ছিলো তাদের।

প্রায় ৫০ ঘণ্টা ধরে এইভাবেই বেঁচে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে ফেরত আসা এসব মানুষ।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত আসা এক বাংলাদেশি রবিউল ইসলাম (ছদ্মনাম) বলেন, 'পুরো বিমানটাই ছিল একটি ভ্রাম্যমাণ উচ্চ-নিরাপত্তাবেষ্টিত কারাগার। পাকিস্তান, নেপাল, ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়া—এমন ছয়টি দেশের মানুষ ছিল আমাদের সঙ্গে। সবাই শিকলে বাঁধা। মাটিতে নামা পর্যন্ত আমরা শিকলবন্দি অবস্থাতেই ছিলাম।'

গত ৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো ৩০ বাংলাদেশির একজন রবিউল।

২০২৫ সালের শুরুর দিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হওয়ার পর থেকে আইসিই (ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট) ব্যাপকভাবে বহিষ্কার কার্যক্রম বাড়িয়েছে। সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ পরিসংখ্যান বলছে, প্রথম ছয় মাসেই প্রায় দেড় লাখ মানুষকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করার পথে রয়েছে তারা।

এরই মধ্যে অন্তত ১৮০ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ জনই ছিলেন সেপ্টেম্বরে পাঠানো ওই দলে।

ফেরত পাঠানোর ধরন আন্তর্জাতিক আইন ও মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী—এমন অভিযোগ তুলেছেন মানবাধিকারকর্মী এবং ভুক্তভোগীরা নিজেরাও।

মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, 'কোনো প্রশাসনই অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ অনুমোদন করতে বা ব্যবহার করতে পারে না। এসব ঘটনা চিহ্নিত করা, আলোচনায় আনা এবং তদন্ত হওয়া জরুরি।'

'ফেরত পাঠানো বহু মানুষ জানিয়েছে, তাদের ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করা হয়েছে—যেমন হাতকড়া পরানো অবস্থাতেই খাওয়া বা টয়লেট ব্যবহার করতে বাধ্য করা।'

সেপ্টেম্বরে ওই ফ্লাইটেই ছিলেন সিলেটের মাসুদ আহমেদ। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পথে তাকে নিজের পরিবারের থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। সীমান্তে পৌঁছাতেই মার্কিন কর্তৃপক্ষ তাকে তার গর্ভবতী স্ত্রী থেকে আলাদা করে ফেলে। পরে তার স্ত্রীকে অস্থায়ীভাবে এক আত্মীয়ের কাছে রাখা হয়, সেখানেই জন্ম নেয় তাদের মেয়ে। কিন্তু মাসুদ আর নিজের নবজাতককে দেখতে পাননি।

বরং তাকে ফেরত পাঠানো হয় বাংলাদেশে।

ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের প্রতি আচরণ ছিল অমানবিক ও অসম্মানজনক। আমাদের যেভাবে ফেরত পাঠানো হয়েছে, তা মানবজাতির জন্যই অপমানজনক।' 

২০১২ সাল থেকে মাসুদ ব্রাজিলে বসবাস করছিলেন। সেখানে নাগরিকত্বও পান তিনি ও তার স্ত্রী। দু'জনের কাছেই ছিল ব্রাজিলিয়ান পাসপোর্ট।

এই নথি থাকার কারণে যাত্রাপথে তাদের তেমন কোনো জটিলতা হয়নি। নিকারাগুয়া হয়ে কয়েকটি মধ্য আমেরিকার দেশ অতিক্রম করে তারা মেক্সিকোতে পৌঁছান। সেখান থেকে টেক্সাস সীমান্ত দিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেন। আর সেখানেই আটক হন মাসুদ।

তাদের হাতে ব্রাজিলিয়ান পাসপোর্ট থাকায় তারা আটক ছিলেন মাত্র ১৭ দিনের মতো। অথচ অন্য অনেকের যাত্রা ছিল ভয়ংকর দীর্ঘ, ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিপজ্জনক। তারা 'স্বাধীনতার দেশ'-এ পা রাখলেও, শেষ পরিণতি হয়েছে একই—বন্দি হওয়া এবং অবশেষে বহিষ্কৃত হওয়া।

রবিউল ইসলামও প্রথমে কাজের ভিসা নিয়ে গিয়েছিলেন ব্রাজিলে। উদ্দেশ্য ছিল সেখান থেকে ঝুঁকিপূর্ণ পথ ধরে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানো। ব্রাজিল থেকে পেরু, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া অতিক্রম করে তিনি ভয়ংকর দারিয়েন গ্যাপ হয়ে পানামায় পৌঁছান। সেখান থেকে কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস ও গুয়াতেমালা পেরিয়ে অবশেষে মেক্সিকোতে পৌঁছে যান।

মাসুদের মতো তাকেও দালাল ও মানবপাচারকারীদের ওপর ভরসা করতে হয়েছিল। তবে পার্থক্য হলো—রবিউল যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেন অ্যারিজোনার সীমান্ত দিয়ে। তার সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশি ছাড়াও আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার অন্যান্য অভিবাসীরা।

পরিকল্পনা ছিল, সীমান্তে গিয়ে নিজেরাই আত্মসমর্পণ করবেন। লুকিয়ে থাকার চেয়ে নিবন্ধিত হওয়া নিরাপদ ভেবেছিলেন সবাই। সেটি প্রায় দেড় বছর আগের ঘটনা, জো বাইডেনের সময়ে। অনেকে ভেবেছিলেন এতে যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যাওয়ার সুযোগ বাড়বে, কিন্তু রবিউলের অভিজ্ঞতা বলছে বাইডেনের আমলেও বাস্তবতা ছিল একই রকম।

প্রায় দেড় বছর আটক থাকার পর তাকে বের করে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, 'ভোর ৪টায় নাস্তা, দুপুর ১২টায় লাঞ্চ আর বিকেল ৪টায় রাতের খাবার দিত। ভোর ৪টায় কেউ নাস্তা করে? আর আমাদের জন্য ছিল শুধু বিনস জাতীয় খাবার। বাংলাদেশে কে শুধু বিনস খায়?'

মার্কিন স্বপ্নে রবিউল বিপুল পরিমাণ অর্থও খরচ করেছিলেন।

তিনি জানান, ৫০ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। 'সবই দালালদের হাতে দিয়েছি। তারা আমাদের আমেরিকা পর্যন্ত এনেছিল, কিন্তু সেখানে বসতি গড়া আমার নিয়তিতে ছিল না।'

একই ধরনের আর্থিক ক্ষতির কথা বলেছেন হবিগঞ্জের আরেক বাংলাদেশি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ ব্যক্তির ভাই বলেন, 'আমাদের পরিবার এলাকায় হাসির পাত্র হবে। সবাই জানত আমার ভাই আমেরিকা পৌঁছেছে, এতে একটা গর্ব ছিল। এখন সেই গর্ব লজ্জায় পরিণত হয়েছে।'

রবিউল জানান, ২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায়ই তিনি বিমানটিতে ওঠেন। শুরু থেকেই হাতকড়া ও শিকলে আটকানো হয় তাকে। সন্ধ্যায় ওঠার পরও বিমান উড্ডয়ন করে রাত ১০টার দিকে।

তিনি বলেন, 'আমাদের প্রথম যাত্রা বিরতি ছিল রোমানিয়ায়। তবে নিশ্চিত হতে পারিনি, কারণ আমাদের বিমান থেকে নামতে দেওয়া হয়নি। হয়তো কাতারেও থেমেছিল। আমরা নিশ্চিত হয়েছিলাম পাকিস্তানে নেমে, কারণ তখন পাকিস্তানি যাত্রীদের নামানো হয়।'

এরপর নামানো হয় নেপালিদের। আর অবশেষে ৫ সেপ্টেম্বর রাত প্রায় ১২টার দিকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায় বিমান। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফেরত যাওয়া যাত্রীদের দুর্ভোগ আরও দীর্ঘায়িত হয়েছিল।

'টয়লেটে যাওয়ার সময় শুধু এক হাত খোলা হতো আমাদের। এরপরেই আবার হাতকড়া পরানো হতো। কিন্তু প্রস্রাবের সময় কোনোভাবেই হাতকড়া খোলা হয়নি,' বলেন রবিউল।

'ঘন্টার পর ঘন্টা শিকলে আটকে থাকার পর যদি হাতকড়া সামান্য আলগা করতে বলতাম, তারা বলত—না, এভাবেই ঠিক আছে। কোনো অজুহাত দেখাবে না।'

খাবারের সময়ও ছিল অমানবিকতা। যাত্রীরা মাথা নিচু করে থাকতেন, আর পাশে বসা কোনো সহযাত্রী—যার হাত সামনের দিকে বাঁধা থাকত—সে-ই মুখের দিকে খাবার ঠেলে দিত।

ক্ষোভজড়িত কণ্ঠে মাসুদ সহমত পোষন করে বলেন, 'আমাদের খাবার খাওয়ার অবস্থা ছিল এরকমই অদ্ভুত ও অমানবিক।'

তবে তার দুর্দশা এখানেই শেষ নয়। এখন আবার কোনো ঝামেলা ছাড়া ব্রাজিলে ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজতে হবে তাকে, যাতে সেখানে ফেরত পাঠানো হলে স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে দেখা মেলে।

তিনি বলেন, 'সেখানে আমার কাজ ছিল, আমি নতুন করে জীবন গড়তে পারি। কিন্তু সাহায্যের জন্য কার কাছে যাব জানি না।'

মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন মনে করেন, কেউ যদি সত্যিই আইন ভঙ্গ করে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাকে গ্রেপ্তার করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেই পারে। 'কিন্তু আমরা যা দেখছি, তা অন্যরকম।'

তার মতে, ট্রাম্প প্রশাসন আসলে এক ধরনের নির্দিষ্ট শ্রেণির নাগরিককে লক্ষ্যবস্তু করছে। এমনকি কেউ কেউ বৈধভাবে থাকার অনুমতি নিয়েছেন, আশ্রয়ের আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থেকে কর দিচ্ছেন—তাদেরও বহিষ্কারের শিকার হতে হচ্ছে। প্রশ্ন জাগছে, এই বহিষ্কারগুলো আদৌ আইনসম্মত কি না।

লেনিন বলেন, 'তারপর আছে পদ্ধতির বিষয়। কেউ আক্রমণাত্মক না হলে তাকে হাতকড়া পরানো যুক্তিসঙ্গত নয়। আটক ব্যক্তিদের ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বেআইনি।'

তিনি আরও বলেন, 'এসব অভিযোগ জাতিসংঘে উত্থাপন করা উচিত। সেখানে বাংলাদেশও আছে। প্রবাসে নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হলে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং মর্যাদার প্রশ্ন তোলে। মনে হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইনকেই সম্মান করা হচ্ছে না—দুই পক্ষই ব্যক্তির অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে।'
 

 

ধ্রুব নিউজের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

💬 Comments

Login | Register
Ad for sale 225 x 270 Position (2)
Position (2)