সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
Ad for sale 100 x 870 Position (1)
Position (1)

এলো যে বর্ষা

সাবিক সাদত সাবিক সাদত
প্রকাশ : বুধবার, ৯ জুলাই,২০২৫, ১১:৪৪ এ এম
এলো যে বর্ষা

জ্যৈষ্ঠের তীব্র গরমের পর কদম ফুলের সুবাস আর মেঘলা আকাশ নিয়ে প্রকৃতিতে আসে বর্ষা। গ্রীষ্মের ভাপসা গরম আর ফলের মধুর স্বাদ শেষে কদম জানান দেয় বর্ষার আগমনী বার্তা। ঋতুচক্রের আবর্তনে বর্ষাকাল বাংলাদেশের আবহাওয়া, পরিবেশ ও মনোজগৎকে সম্পূর্ণ নতুন রূপে সাজিয়ে তোলে। অঝোর ধারায় বৃষ্টিতে সিক্ত হয়ে প্রকৃতি হয়ে ওঠে আরও সজীব ও শ্যামল। তাই কবি-সাহিত্যিকরা আবহমান কাল ধরে বর্ষার বন্দনা করে এসেছেন তাদের অজস্র লেখায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম, এমনকি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কবি-লেখকদের রচনায় বর্ষা এসেছে নানান রূপে। রবীন্দ্রনাথ তার শিশুতোষ কবিতায় আষাঢ়ের এক ভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছেন:

"নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে ওগো আজ তোরা যাসনে গো যাসনে ঘরের বাহিরে।"

এই পংক্তিগুলোতে আষাঢ়ের শুরুর এক গ্রামীণ ছবি ফুটে ওঠে, যেখানে ছোটদের প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে অসুখ বাঁধানোর প্রতি সতর্ক করা হয়েছে। এটি বর্ষার এক চিরাচরিত রূপ যা গ্রামবাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে পরিচিত।

বর্ষাকালের বেশ কিছু ইংরেজি প্রতিশব্দ রয়েছে, যার মধ্যে Rainy Season সবচেয়ে পরিচিত। ছোটদের পাঠ্যবইয়ে এই শব্দটির ব্যবহার বেশি দেখা যায়। এছাড়াও Monsoon এবং Wet Season শব্দগুলোও বর্ষাকাল বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। 'Monsoon' শব্দটি পর্তুগিজ 'Monçao' থেকে এসেছে, যার উৎস আরবি 'মওসুম' বা 'মওসিম'। এর অর্থ 'Season' বা 'কাল'। এই 'মওসুম' শব্দটি বাংলাতেও বহুল প্রচলিত, যা সময় বা আবহাওয়া বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ব্রিটিশ আমল থেকেই বর্ষাকাল বোঝাতে 'Monsoon' শব্দের ব্যবহার দেখা যায়।

বাংলাদেশ একটি উপক্রান্তীয় অঞ্চল (Sub-Tropical zone)। এখানে মূলত তিনটি প্রধান ঋতু লক্ষণীয়: Hot Summer (চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ): মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত প্রচণ্ড গরমের গ্রীষ্মকাল। Cool Rainy Season (আষাঢ় থেকে কার্তিক): জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত শীতল বর্ষাকাল। Cool Dry Winter (অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন): অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ঠাণ্ডা ও শুষ্ক শীতকাল।

যদিও বাংলাদেশে ছয়টি ঋতু বিদ্যমান, গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতকালই বিশেষভাবে অনুভূত হয়। শরৎ, হেমন্ত ও বসন্তের আগমন ও প্রস্থান অনেক সময় আমাদের নজরেও আসে না।

ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল হলেও, বাস্তবে চৈত্র-বৈশাখের কালবৈশাখীর সাথেই বৃষ্টির ছোঁয়া লাগে। জ্যৈষ্ঠ মাসেও কখনো কখনো বর্ষার মতো অঝোর বৃষ্টি নামে, যা বর্ষার আগমনী বার্তা বহন করে। এ বছর যেমন জ্যৈষ্ঠ মাসেই টানা কয়েক দিনের বৃষ্টিতে প্রকৃতিতে বর্ষার ছোঁয়া লেগেছিল। জ্যৈষ্ঠ মাস একদিকে যেমন প্রচণ্ড গরমে অস্বস্তিদায়ক, তেমনি বাহারি ফলের সমাহারে মন ভোলানো। এই মাসেই আম, জাম, কাঁঠাল পাকে। কবির ভাষায় "পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ" - জ্যৈষ্ঠের এই মধুমাস পেরিয়ে গাছে গাছে কদম ফুল ফুটে ওঠে, জানান দেয় আষাঢ়ের আগমনের, বর্ষা ঋতুর পদধ্বনি।

 

বর্ষা মানেই যেন কদম ফুল। কদমের শাখায় শাখায় ফুটে থাকা সুন্দর ফুলগুলো সবার নজর কাড়ে। শহরের বড় স্কুলগুলোর গেটে আজকাল কদম ফুলের ডাল বিক্রি হতে দেখা গেলেও, গ্রামের শিশুরা সৌভাগ্যবান; তারা বিনা পয়সায় গাছ থেকে কদম পেড়ে নিতে পারে। কদম গাছ বেশ উঁচু ও বড় হয় বলে ফুল পাড়া কিছুটা কঠিন। এই ফুলের হালকা মিষ্টি ঘ্রাণ মনকে প্রশান্তি দেয়। শুধু কদমই নয়, কেয়াও বর্ষার আগমনে সজীব হয়ে ওঠে এবং ফুলে ফুলে ভরে যায়।

বর্ষা ঋতু এলে সারা দেশে বৃক্ষরোপণের ধুম পড়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে বৃক্ষমেলা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে গাছের চারা সংগ্রহ করে বাগান বা সড়কের ধারে রোপণ করা হয়। বর্ষাকালে আবহাওয়া বৃষ্টিস্নাত থাকে বলে চারা লাগালে সেগুলো মরে যাওয়ার হার কম থাকে। এ সময়ে বৃষ্টির কারণে সেচ দেওয়ারও তেমন প্রয়োজন হয় না এবং গাছগুলো দ্রুত বেড়ে ওঠে। তাই প্রত্যেকেরই উচিত অন্তত দুটি করে চারা রোপণ করা, যা আমাদের প্রকৃতিকে সবুজ করে তুলবে এবং প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করবে।

বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি এবং উজান থেকে নেমে আসা পানিতে খাল-বিলগুলো ভরে যায়। নদীগুলো জলে টইটম্বুর হয়ে উপচে পড়ে এবং কখনো কখনো বন্যার সৃষ্টি হয়। শ্রাবণ মাসে দেশের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়, গ্রামীণ জনপদ বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয় এবং নৌকা হয়ে ওঠে চলাচলের প্রধান বাহন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উজানে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখার কারণে বর্ষার সেই চিরায়ত রূপ অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। তবুও একটানা বৃষ্টি এবং নদীর স্রোতধারা আমাদের মনে এক ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসে। বৃষ্টি যেমন প্রকৃতিকে ফসলে ভরিয়ে তোলে, তেমনি আমাদের মনকেও ছুঁয়ে যায়। কবি ফররুখ আহমদের মতো অনেক কবিই তাদের শিশুতোষ কবিতায় বৃষ্টির ছন্দ তুলে ধরেছেন:

"বিষ্টি নামে রিমঝিমিয়ে রিমঝিমিয়ে গাছের ডালে টিনের চালে বিষ্টি নামে হাওয়ার তালে বাদলা দিনের একটানা সুর বৃষ্টি নামে ঝুমুর ঝুমুর।"

বর্ষাকালে আমন ধানসহ বিভিন্ন ধরনের ধানের আবাদ করা হয়। এ সময়ে পাট গাছগুলো বড় হয় এবং বর্ষার পানিতে পাটের আবাদও ভালো হয়। বর্ষা শেষে পাট কেটে জাগ দিয়ে আঁশ ছাড়িয়ে শুকাতে হয়। শুষ্ক মৌসুমের অভাবে পাট শুকাতে কিষাণ-কিষাণীদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ধান ও পাট ছাড়া নিচু জমিতে অন্য কোনো ফসল করা যায় না বলে সেগুলো খালি পড়ে থাকে। তবে এসব জমিতে বর্ষায় শাপলা ফোটে, যা বর্ষা শেষের এক মন মুগ্ধ করা চিত্র।

আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল হলেও, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এর প্রভাব আরও কিছুদিন থাকে। বর্ষা আর শরৎ যেন একে অপরের সাথে মিশে যায়। হেমন্তে কার্তিক মাসে পানি সরে গিয়ে ক্ষেত-খামার যখন আবার জেগে ওঠে, তখনই প্রকৃতির বুক থেকে বর্ষার প্রভাব সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়। বর্ষা প্রকৃতিকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেয় এবং জমিতে পলি পড়ার ফলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়, যা ফসলের জন্য জমিকে প্রস্তুত করে তোলে।বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত মূলত মৌসুমি বায়ুর উপস্থিতির কারণে হয়। মৌসুমি বায়ু জ্যৈষ্ঠের ভাপসা গরমের পর প্রশান্তির বাতাস নিয়ে আসে। আষাঢ়-শ্রাবণের অঝোর বর্ষণ গোটা পরিবেশকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে।

ধ্রুব নিউজের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

💬 Comments

Login | Register
Ad for sale 225 x 270 Position (2)
Position (2)