মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫
Ad for sale 100 x 870 Position (1)
Position (1)

চতুর্দিকে মৃত্যুফাঁদ

ধ্রুব নিউজ ডেস্ক ধ্রুব নিউজ ডেস্ক
প্রকাশ : সোমবার, ২৭ অক্টোবর,২০২৫, ০৭:৩৮ পিএম
চতুর্দিকে মৃত্যুফাঁদ

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেলের পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনার পর অনেকের আলোচনাতেই ঘুরে ফিরে আসছে- এই শহরে কে কখন কোন ধরনের দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাবে-তার নিশ্চয়তা কোথায়?

সামাজিক মাধ্যমে অনেকে বিভিন্ন সময়ে এমন মৃত্যুর ঘটনা তুলে ধরে লিখছেন- এই শহরে কারও ওপর বিয়ারিং প্যাড পড়ে, কেউ ওপর থেকে ইট পড়ে, কেউ অটোরিকশার ধাক্কায়, কেউ ময়লার গাড়ীর ধাক্কায়, কেউ বা দুই বাসের চিপায় পড়ে মারা যাচ্ছে।

এমনকি স্কুলের ওপর বিমান বিধ্বস্ত হয়ে শিক্ষার্থী-শিক্ষকের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে এই ঢাকাতেই।

এসব ঘটনার কথা উল্লেখ করে সামাজিক মাধ্যমে কেউ লিখছেন 'এই শহরে মানুষের জীবনই সবচেয়ে সস্তা', আবার কেউ লিখছেন 'ঢাকা শহরে জীবনের কোনো দাম নেই। যখন তখন উধাও হয়ে যেতে পারে'।

সমাজ বিশ্লেষক ও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনাগুলো কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং 'ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা জনিত হত্যাকাণ্ড'।

তাদের মতে, যাদের ব্যর্থতা বা দায়িত্বে অবহেলার জন্য এসব ঘটে তাদের কখনোই কোনো শাস্তি হয় না বলেই এসব ঘটনা ঘটেই চলেছে।

তারা বলছেন, দায়িত্বে অবহেলা এমন পর্যায়ে গেছে যে ফ্লাইওভার থেকে প্রকাশ্যে দিবালোকে নাটবল্টু খুলে নেয়ার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পরেও কাউকে এসব নিয়ে সক্রিয় হতে দেখা যায় না।

এদিকে ঢাকায় মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে নিহত আবুল কালামের জানাজা শেষে আজ তাকে শরিয়তপুরের নড়িয়ায় দাফন করা হয়েছে।

বিয়ারিং প্যাডে মৃত্যু
আবুল কালাম তার নারায়ণগঞ্জের বাসা থেকে মতিঝিলে এসেছিলেন সোমবার সকালে। এরপর কাজের প্রয়োজনে এসেছিলেন ফার্মগেট এলাকায়। সেখানেই ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মেট্রোরেলের পিলারের বিয়ারিং প্যাড পড়ে তার মৃত্যু হয়।

ছয় বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোটো আবুল কালাম নিজেও দুই সন্তানের পিতা ছিলেন। তার মৃত্যুর খবর মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায় সামাজিক মাধ্যমে। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয় অনেকের মধ্যে।

এ ঘটনার পর মেট্রোরেলের পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার কারণ অনুসন্ধানে একটি কমিটি গঠন এবং নিহতের পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে সরকার।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবেই প্রতিটি ঘটনার পর হয় তদন্ত কমিটি না হয় টুকটাক ক্ষতিপূরণ দিয়ে ঘটনাগুলোকে ধামাচাপা দেয়া হয়।

"এগুলো হত্যাকাণ্ড। যাদের দায়িত্ব অবহেলার জন্য এগুলো ঘটে তাদের বিরুদ্ধে কখনোই ব্যবস্থা নেয়ার নজির এখানে নেই,"  বলছিলেন নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব।

ফার্মগেটে আবুল কালামের হুট করে মৃত্যুর ঘটনায় অনেকেই তুলে আনছেন গত কয়েক বছরে ঢাকায় ঘটে যাওয়া এ ধরনের কিছু ঘটনা। এসব ঘটনায় কারও উপর থেকে ইট পড়ে মৃত্যু হয়েছে আবার কাউকে গাড়ী ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছে।

তবে ঢাকায় এ যাবতকালের এমন আকস্মিক মৃত্যুর সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা হলো ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বাহিনীর বিমান বিধ্বস্ত হওয়া। এতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক মিলিয়ে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৩৫ জন। আহত হয়েছেন আরও অনেকে।

দুই হাজার চব্বিশ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংক কর্মকর্তা দীপান্বিতা বিশ্বাস দীপুর মৃত্যুর দৃশ্য ভাইরাল হয়েছিলো সামাজিক মাধ্যমে। অফিস শেষ করে মগবাজারের বাসার দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনি। মৌচাক এলাকায় আচমকা একটি ইট ওপর থেকে তার মাথায় পড়লে সেখানেই মৃত্যু হয়।

তার আগে ২০২২ সালের অগাস্টে ঢাকার ব্যস্ত একটি রাস্তায় ফ্লাইওভারের গার্ডার তোলার সময় ক্রেন চলন্ত গাড়ির ওপর পরে এক নবদম্পতি সহ পাঁচ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় তোলপাড় হয়েছিলো। তখনো এ নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছিলো।

কিন্তু এমন আলোচিত ঘটনাতেও দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেয়ার কোনো পদক্ষেপই নেয়া হয়নি।

শুধু ইট পড়া, মেট্রোরেলের পিলার কিংবা ফ্লাইওভারের ক্রেন পড়ে মৃত্যুর ঘটনাই নয়। বরং অটোরিকশার আঘাতেও প্রাণ হারানোর উদাহরণ আছে এই শহরে।

চলতি বছরের এপ্রিলে ঢাকার মুগদা থানার মানিক নগর এলাকায় অটোরিকশার ধাক্কায় সুমি (২৫) নামে এক নারী নিহত হয়েছিলেন। তিনি রাত সাড়ে ৯টার দিকে মানিক নগর ওয়াসা রোড দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময়ে ওই ঘটনা ঘটে।

আবার গত বৃহস্পতিবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন (৩৫) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। তিনি একটি লন্ড্রির দোকানে কাজ করতেন। ওইদিন রাতে বনানীতে গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন এক নারী।

এর একদিন পর শনিবারে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর হানিফ ফ্লাইওভারে শনিবার পুলিশের একটি রেকার গাড়ির চাপায় মো. কাওছার আহামেদ নামের এক মোটরসাইকেল আরোহী মারা গেছেন।

ঢাকার রাস্তায় নিয়মিত চলাচল করেন আমিনুল ইসলাম। তার মতে, সড়ক ফুটপাত এমনকি কাঁচাবাজারে গেলেও আতঙ্কে থাকতে হয় কখন কোন দুর্ঘটনা ঘটে।

"ফুটপাতে বাইক কিংবা অটোরিকশা উঠে যায়। কার ধাক্কায় কখন মরতে হয় কে জানে। বাজারে গেলেও টেনশনে থাকি কখন কি ভেঙ্গে পড়ে মাথার ওপর,"  বলছিলেন তিনি।

নির্মাণ কোম্পানিতে কাজ করেন নিজাম উদ্দিন। কাজের প্রয়োজনে নিয়মিত মোহাম্মদপুর উত্তরা যেতে হয় তাকে। "সবসময় একটা আতঙ্কে থাকতে হয়। এভাবে কি চলা যায়,?"বলছিলেন তিনি।

কেন এগুলো ঘটেই চলেছে
সমাজ বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলছেন, জীবনযাপন কেন্দ্রিক নানা ত্রুটি ও অব্যবস্থাপনার কারণে ঢাকা মূলত মানুষের জন্য একটি মৃত্যু ফাঁদের শহরে পরিণত হয়েছে।

"পথচারী, যাত্রী- কারও নিরাপত্তা নেই, কে কখন কিভাবে মরবে কারও জানা নেই। এখানে কারও জীবনের কোনও নিশ্চয়তা নেই। আকস্মিক মৃত্যু বা বিচ্ছিন্ন ঘটনার মোড়কে এগুলোকে ধামাচাপা দেয়া হয়। কাদের ভুলে বা অবহেলার ফলে এগুলো হয় সেগুলো কখনো জানাই যায় না,"  বলেছেন তিনি।

তার মতে, এ ধরনের মৃত্যুগুলো মূলত 'ব্যর্থতা থেকে সৃষ্টি হত্যাকাণ্ড' এবং তিনি মনে করেন জবাবদিহিতা নিশ্চিত না গেলে এগুলো থেকে মুক্তি মিলবে না।

"কে কখন মৃত্যু ফাঁদে পড়বে বলা মুশকিল—কারণ চারপাশেই ছড়িয়ে আছে এমন বিভিন্ন ধরনের মৃত্যুফাঁদ। কিছু ঘটলে বলা হবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বা তদন্ত কমিটি করে আর্থিক ক্ষতিপূরণের মধ্য দিয়ে ধামাচাপা দেয়া হবে। দীর্ঘকালের চর্চা এটি," বলছিলেন মি. হক।

স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলছেন, অবহেলা জনিত শাস্তির বিধান নেই বলেই কোনও ঘটনার বিচার হয় না।

"এই যে ভবন থেকে ইট পড়ে কিংবা পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড পড়ে বা ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে এগুলো নির্মাণকালীণ অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে থাকে তাদের কখনো দায়িত্বে অবহেলার জন্য শাস্তি হয়েছে? হয়নি বলেই এগুলো ঘটেই চলেছে," বলছিলেন তিনি। সূত্র : বিবিসি বাংলা

ধ্রুব নিউজের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

💬 Comments

Login | Register
Ad for sale 225 x 270 Position (2)
Position (2)