সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
Ad for sale 100 x 870 Position (1)
Position (1)

নিরাপদ মাতৃত্বের চ্যালেঞ্জ আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতা

ধ্রুব নিউজ ডেস্ক ধ্রুব নিউজ ডেস্ক
প্রকাশ : শনিবার, ১২ জুলাই,২০২৫, ১২:১৭ এ এম
নিরাপদ মাতৃত্বের চ্যালেঞ্জ আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতা


মাতৃত্ব মানব জীবনের এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা, যা নারীর জীবনকে পূর্ণতা দেয়। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা সব সময় মসৃণ হয় না। জান্নাতুল মাওয়া তার লেখায় নিরাপদ মাতৃত্বের চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেছেন, যেখানে প্রসবকালীন জটিলতা থেকে শুরু করে সামাজিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতাগুলোকেও আলোচনা করা হয়েছে। তাজমহলের পেছনে মমতাজের প্রসবকালীন মৃত্যুর করুণ গল্প থেকে শুরু করে আধুনিক যুগে মাতৃমৃত্যুর পরিসংখ্যান, সবই উঠে এসেছে এই লেখায়।

মমতাজ বেগম, যার জন্য পৃথিবীর অন্যতম ভালোবাসার নিদর্শন তাজমহল নির্মিত হয়েছে, তিনিও ১৪তম সন্তান জন্মদানের সময় মাত্র ৩৮ বছর বয়সে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গিয়েছিলেন। এই মর্মান্তিক ঘটনা দেখায় যে, সম্পদ, ক্ষমতা বা ভালোবাসা কোনো কিছুই অনিরাপদ মাতৃত্ব থেকে রক্ষা করতে পারে না। অতীতে যেমন সম্রাজ্ঞী থেকে সাধারণ মা, অসংখ্য নারী প্রসবকালীন জটিলতায় অকালে প্রাণ হারিয়েছেন, তেমনি অনেক শিশু মা-হারা হয়েছে।

জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানেও গর্ভাবস্থায় এবং প্রসব সম্পর্কিত প্রতিরোধযোগ্য কারণে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ নারীর মৃত্যু হয়, অর্থাৎ প্রতি ২ মিনিটে একজন নারী মারা যান। ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারীরা আঘাত, সংক্রমণ এবং প্রতিরোধযোগ্য প্রতিবন্ধকতার কারণে মারা যান। ২০১৭ সালে আনুমানিক সাড়ে ২৯ হাজার নারী মারা গিয়েছিলেন গুরুতর রক্তপাত, সেপসিস, একলাম্পসিয়া, বাধাগ্রস্ত প্রসব এবং অনিরাপদ গর্ভপাতের কারণে, যা চিকিৎসা ব্যবস্থার হস্তক্ষেপে সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য। এদের মধ্যে প্রায় ৮৬ শতাংশই সাব-সাহারা আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার নারী।

তবে আশার কথা হলো, ২০০০ সাল থেকে মাতৃমৃত্যুর হারে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইউনিসেফের তথ্যমতে, ২০০০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মাতৃমৃত্যুর হার ৩৮ শতাংশ কমে প্রতি এক লাখে ৩৪২ থেকে ২১১ জনে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়াতে এই হার আরও বেশি কমেছে, ৫৯ শতাংশ হ্রাস পেয়ে প্রতি লাখে ৩৯৫ থেকে ১৬৩ জনে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে: ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতি লাখে ৩২২ থেকে ১৯৪-তে কমেছে এবং ২০১৫ সালে ১৭৬, ২০১৭ সালে ১৭৩ জনে দাঁড়িয়েছে। ধারণা করা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সাফল্য আরও বেড়েছে।

মাতৃমৃত্যুহার একেবারে শূন্যের কোঠায় না এলে নিরাপদ মাতৃত্ব পুরোপুরি অর্জন করা সম্ভব নয়। তবে নিরাপদ মাতৃত্ব শুধু মাতৃমৃত্যুহার কমানো নয়। এর অর্থ হলো, একজন নারী মা হবেন কিনা, কখন হবেন, সেটি একান্তই তার সিদ্ধান্ত। গর্ভধারণ থেকে শুরু করে শিশুর জন্মের পর পর্যন্ত সব সেবা ও সুবিধার সুযোগ পাওয়া এবং এ সময়ে সব তথ্য, করণীয় ও জরুরি প্রসূতি সেবা পাওয়া। গর্ভধারণ থেকে শুরু করে ৪২ দিন পর পর্যন্ত নিরাপত্তা পাওয়া কিন্তু নিরাপদ মাতৃত্ব অর্জনের একমাত্র লক্ষ্য নয়; বাকি বিষয়গুলোও পূরণ করতে হবে।

অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী তার 'নিরাপদ মাতৃত্বের জন্যে' বইয়ে মাতৃমৃত্যুর মূল কারণ হিসেবে রক্তক্ষরণ, সংক্রমিত গর্ভপাত, একলাম্পসিয়া, প্রসব-পরবর্তী সংক্রমণ, এবং বাধাগ্রস্ত প্রসবের কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া, প্রসব সংক্রান্ত কারণে দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা যেমন—জরায়ুর সংক্রমণ, রক্তস্বল্পতা, পেরিনিয়াম ছিঁড়ে যাওয়া, ভেসিকো ভেজাইনাল ফিস্টুলা, অনবরত প্রসব, রেকটো ভেজাইনাল ফিস্টুলা ও বন্ধ্যত্ব হতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে চারটি স্তম্ভ চিহ্নিত করেছে: ১. পরিবার পরিকল্পনা ২. গর্ভকালীন সেবা ৩. নিরাপদ প্রসব ৪. জরুরি প্রসূতি সেবা

নিরাপদ মাতৃত্ব ও শিশুমৃত্যু কমাতে এই চারটি স্তম্ভ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নিরাপদ মাতৃত্ব সব নারীর অধিকার হলেও, এটি অর্জন করতে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। এসব চ্যালেঞ্জের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে শারীরিক জটিলতা, মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতি, পারিপার্শ্বিক সম্পর্ক ও পরিবেশ।

কানিজ শাইমা (৩২), একজন উন্নয়নকর্মী, তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন: করোনার সময় বিয়ে এবং বয়স হয়ে যাচ্ছে বলে বাচ্চা নেওয়ার চাপ তাকে মানসিকভাবে হতাশ করে তুলেছিল। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর পরিবার থেকে বাড়ির কাজ এবং বিশ্রাম না নেওয়ার জন্য চাপ আসত। তার নিম্ন ও উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট এবং ঘুমের সমস্যাকে পরিবারের সদস্যরা বুঝত না। খাদ্যাভ্যাসে নানা প্রতিবন্ধকতা এবং ছেলে সন্তান প্রসবের জন্য চাপ তাকে ভীষণ যন্ত্রণা দিত।

সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার বাল্যবিয়ের শিকার কেয়া (১৭) এর অভিজ্ঞতা: বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চা নেওয়ার চাপ তাকে অসুস্থ করে তুলেছিল। লোনা ও নোংরা পানিতে গোসল করতে হওয়ায় তার গায়ে ঘা, প্রস্রাবে জ্বালা এবং উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা ছিল। খাওয়ার পানির সমস্যা থাকায় পরিষ্কার পানির অভাব তার স্বাস্থ্যকে আরও খারাপ করেছিল।

বিশেষজ্ঞদের মত: লন্ডনের এইচএস ট্রাস্টের কনসালট্যান্ট মিডওয়াইফ এবং ওয়ার্ল্ড কলেজ অব মিডওয়াইফ গ্লোবালের ফেলো সারা গ্রেগসান মনে করেন, অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোতে শিক্ষা, দারিদ্র্য ও উন্নত স্বাস্থ্যসেবার অভাবে মাতৃমৃত্যু বেশি হচ্ছে। বর্তমানে মাতৃত্বকালীন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো করোনা মহামারি, যার কারণে অনাবশ্যক অনেক মা ও শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। তিনি বলেন, যদিও উন্নত ও অনুন্নত দেশ মিলে মাতৃমৃত্যুহার রোধে অগ্রগতি অর্জন করা হয়েছে, এখন তা থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়ছি।

বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর বড় চ্যালেঞ্জগুলো হলো:

·         বাল্যবিয়ে

·         দারিদ্র্য

·         স্বাস্থ্যসেবার অসহজলভ্যতা

·         স্বাস্থ্যশিক্ষার অভাব

সারা গ্রেগসান বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে ধনী ও দরিদ্র শ্রেণিতে ভাগ করেন। ধনীরা সিজারের দিকে ঝুঁকছে বেশি, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা প্রয়োজন হয় না। দরিদ্রদের জন্য নির্ধারিত স্বাস্থ্যসেবার কাছে পৌঁছানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশ মিডওয়াইফারি সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারি সঙ্গীতা সাহা প্রেমা বলেন, "আমাদের দেশে মাতৃমৃত্যুর বড় চ্যালেঞ্জ হলো হাসপাতালে ডেলিভারি করতে অনাগ্রহ, দূরবর্তী অবস্থান, আর্থিক অসচ্ছলতা, পরিবারের সহযোগিতা না থাকা, পর্যাপ্ত খাবারের অভাব, এবং ছেলে সন্তান কামনা। এগুলো একজন মায়ের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা।"

তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, "বাংলাদেশে যাঁরা মিডওয়াইফ হিসেবে কাজ করছেন, তাঁদের মূল দায়িত্ব অন্তঃসত্ত্বা মায়ের সেবা। মিডওয়াইফদের পোস্টিংই ইউনিয়ন থেকে, ফলে মায়েদের দূরে যেতে হচ্ছে না। তারা যখন আসছেন, তখনই পরিবারের লোকজন সঙ্গে থাকছেন এবং কাউন্সেলিংও হয়ে যাচ্ছে। তারা ফ্রি ওষুধও পাচ্ছেন। এখন কিন্তু মাতৃমৃত্যুহার অনেক কমে গেছে এবং এই সাফল্যে অনেকের চেয়ে আমরা এগিয়ে।"

ভবিষ্যতের অঙ্গীকার
লেখার শুরুতেই বলা হয়েছিল, সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা গেলে সমাধানও পাওয়া যাবে। বিশ্বব্যাপী মাতৃমৃত্যুর ভয়াবহতা উপলব্ধি করে মাতৃত্বকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর অঙ্গীকার নিয়ে ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালিত হয়। এই দিবসে নতুন করে মায়েদের মৃত্যুর তালিকার বদলে মাতৃমৃত্যু শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে—এমন সুসংবাদ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জানানো হয়েছে। সত্যিকার অর্থে মায়েদের জন্য ঝুঁকিহীন ও নিরাপদ দেশ এবং পৃথিবীই আমাদের কাম্য।

 

 

ধ্রুব নিউজের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

💬 Comments

Login | Register
Ad for sale 225 x 270 Position (2)
Position (2)