ধ্রুব ফিচার ডেস্ক
চুল কাটা, দাড়ি কামানো – আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ এই পেশার আড়ালে প্রদীপ প্রোজ্জ্বল নামের এক নরসুন্দর বুনে চলেছেন এক অসাধারণ স্বপ্ন। তার সেলুন শুধু জীবিকার স্থান নয়, বরং তা হাজারো বইয়ের এক নীরব পাঠাগার। কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে উঠে আসা এই মানুষটি জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখে স্কুলের আঙিনা ছাড়লেও, বই আর সাহিত্যের সঙ্গে তার সম্পর্ক কখনও ছেদ পড়েনি।
জীবনের পথে নরসুন্দর, স্বপ্নের পথে লেখক
প্রদীপ প্রোজ্জ্বলের জন্ম ১৯৮৫ সালে। শৈশবেই বাবা-মাকে হারানো এই মানুষটি বড় হয়েছেন মামা ও দিদিমার কাছে। জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতায় মাত্র তিন বছর বয়স থেকেই একাকীত্বের মুখোমুখি হন। প্রদীপ এমন কিছু করতে চেয়েছিলেন যা তাকে কখনও ছেড়ে যাবে না— এই ভাবনা থেকেই মামার কাছ থেকে শিখে নেন নরসুন্দর পেশার কাজ। পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা আর দারিদ্র্যের কারণে নবম শ্রেণির বেশি এগোয়নি তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। পঞ্চম শ্রেণি থেকেই মামার সেলুনে হাত লাগানো শুরু করেন।
স্কুল জীবন শেষ হলেও প্রদীপ নিজের লেখাপড়া বন্ধ করেননি। রবীন্দ্রনাথ যেমন স্কুল পালিয়ে হয়েছিলেন বিশ্বকবি, তেমনি প্রদীপ স্কুল হারিয়ে হলেন সম্ভাবনাময় একজন কবি। ইতোমধ্যে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা নয়টি— ছয়টি কাব্যগ্রন্থ, একটি শিশুতোষ গ্রন্থ, একটি উপন্যাস ও একটি গল্পগ্রন্থ। প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে।
কক্সবাজার, ঢাকা হয়ে প্রদীপ ফিরে আসেন চট্টগ্রামে। ২০১০ সালে চকবাজারের আতুরার দোকান এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন তার প্রথম সেলুন, নাম 'অদ্বৈত হেয়ার ড্রেসার'। সেই থেকে এই সেলুনই তার জীবিকার একমাত্র উৎস। তবে এই সেলুনের মাধ্যমেই নরসুন্দর ছাপিয়ে আজ তার অন্য এক পরিচয়— লেখক ও সমাজ সংস্কারক।
বইয়ের কাছে আশ্রয়, সেলুনে পাঠাগার
চুল কাটা বা দাড়ি কামানোর কাজের ফাঁকে প্রদীপের অবসর কাটে বইয়ের সঙ্গে। ব্যক্তিগত জীবনের না পাওয়া, কষ্ট আর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন বইয়ের কাছেই। সেই ভালোবাসা থেকেই সেলুন প্রতিষ্ঠার পর সেখানেও কিছু বই রাখা শুরু করেন।
প্রথমদিকে নিজের পড়া বইগুলো রাখতেন। কাজের ফাঁকে পড়তেন। যখন কোনো গ্রাহককে সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষা করতে হতো, প্রদীপ নিজ থেকেই বইগুলো তুলে দিতেন তাদের হাতে। গ্রাহকরাও সময় কাটানোর একটি ভালো সুযোগ পেলেন। এভাবেই শুরু হলো তার সেলুন পাঠাগারের পথচলা। এখন বিভিন্ন প্রকাশনী, অনলাইন শপ থেকে বই কিনে তার পাঠাগার সমৃদ্ধ হচ্ছে। বর্তমানে তার 'প্রোজ্জ্বল পাঠাগারে' বইয়ের সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। ইতিহাস, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, রাজনীতি, বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদসহ নানা ধরনের বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে এখানে।
প্রদীপের এই পাঠাগার প্রতিষ্ঠার পর গ্রাহকরা আর বিরক্তি হন না, বরং পছন্দমতো বই নিয়ে বসে পড়েন। শুধু গ্রাহকরাই নন, বইয়ের লোভে আশপাশের স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছাত্ররাও আসেন প্রদীপের সেলুনে। অনেকে ছোট ছোট বাচ্চাকে নিয়ে আসেন বইয়ের সাথে অভ্যাস করানোর জন্য।
স্বপ্ন এখন আরও বড়
কবিতা লেখা বা পড়ার জন্য প্রদীপের নির্দিষ্ট কোনো চেয়ার-টেবিল লাগে না। শেভিং জেল মাখাতে মাখাতে মাথায় আসা কবিতার লাইনগুলো তিনি সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ফোনে টুকে নেন।
সাহিত্য নিয়ে প্রদীপের স্বপ্ন অনেক বড়। তিনি চান তার পাঠাগারকে আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে দিতে। শিগগিরই সদস্যপদ চালু করবেন, যাতে নির্দিষ্ট জামানতের বিনিময়ে পাঠকরা বই বাসায় নিয়ে পড়তে পারেন।
সাহসী ও স্বপ্নবাজ প্রদীপ ইতোমধ্যে শুধু নয়টি বই প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হননি, ২০২৩ সালে তিনি 'প্রোজ্জ্বল পাঠাগার সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩' প্রদান করেছেন তিন ক্যাটাগরিতে ছয়জন লেখককে। পাশাপাশি 'প্রোজ্জ্বল পাঠাগার' নামেই একটি ম্যাগাজিনও সম্পাদনা করেছেন।
লেখক, প্রকাশক ও সাহিত্যিকদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক। অবসরে সেলুনেই আয়োজন করেন সাহিত্য আড্ডা। জীবিকা নির্বাহের জন্য সেলুন হলেও, তার মূল স্বপ্ন এই পাঠাগারকে নিয়ে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে তার আরেকটি সেলুনেও 'প্রোজ্জ্বল পাঠগার' এর কাজ চলছে। এমনকি নিজ গ্রামেও দুটি পাঠাগারের জন্য বই পাঠিয়েছেন তিনি।
প্রদীপের সেলুন তাই শুধু চুল কাটার জায়গা নয়, এটি একটি প্রগতিশীল, মার্জিত ও শুদ্ধ মানুষদের মিলনক্ষেত্র। তিনি বলেন, "আমার এই সেলুন আমি মনে করি একটি প্রগতিশীল, মার্জিত শুদ্ধ মানুষদের জায়গা... এখানেও গল্প আড্ডা হয় কিন্তু পরিবেশটাই এমন রাখতে চেয়েছি যেন গল্পগুলোও হয় মার্জিত, প্রাসঙ্গিক।"
এভাবেই নরসুন্দর ও লেখক— দুই পরিচয়ে প্রদীপ প্রোজ্জ্বল তার সেলুনকে পরিণত করেছেন এক অনন্য বই বিলাসের কেন্দ্রে।