বাংলাদেশের কৃষি খাতে একটি অসাধারণ পরিবর্তন নিয়ে এসেছে 'রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন' প্রকল্পটি। মাত্র ৬২ কোটি ৩৭ লাখ টাকার স্বল্প বরাদ্দ এবং পাঁচ বছরের সময়সীমার (জুলাই ২০২২ - জুন ২০২৭) এই উদ্যোগটি দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় কৃষিপণ্য আমকে বিশ্ববাজারে পরিচিত করার ক্ষেত্রে এক রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) দ্বারা বাস্তবায়িত এই প্রকল্পটি বরাদ্দের দিক থেকে ডিএই'র ৩২টি চলমান প্রকল্পের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন হলেও, এর কার্যক্রম ও সাফল্যে কৃষি উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে
বাংলাদেশের আম চাষের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের, যা এতদিন মূলত অভ্যন্তরীণ বাজারেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এই প্রকল্পের হাত ধরে এখন সেই আমই ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়াসহ বিশ্বের ৩৬টি দেশে পাড়ি জমাচ্ছে।
· রপ্তানির বৃদ্ধি: ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩ হাজার ৯২ টন আম রপ্তানি করেছে, যা আগের বছরের প্রায় দ্বিগুণ।
· নতুন বাজার: আম রপ্তানির তালিকায় এই বছর নতুন করে চীন যুক্ত হয়েছে, যেখানে এরই মধ্যে তিন টন আম রপ্তানি হয়েছে।
· চলতি মৌসুমের লক্ষ্যমাত্রা: গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আম রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭১০ টন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ। চলতি মৌসুমে কৃষি মন্ত্রণালয় প্রায় ৪ হাজার টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
· জনপ্রিয় জাত: বিশ্ববাজারে 'ক্ষীরসাপাতি', 'গোপালভোগ', 'ফজলি', 'হাঁড়িভাঙ্গা' ও 'আম্রপালি'-এর মতো দেশি জাতের আমের কদর বাড়ছে।
এই প্রকল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো কৃষকদের ইউরোপীয় মান অনুসারে আম চাষ, প্যাকিং ও রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান।
· প্রদর্শনী প্লট: প্রকল্পের আওতায় দেশের ১৫টি জেলার ৪৬টি উপজেলায় ২৭৬০টির বেশি উত্তম কৃষি চর্চা (জিএপি) ভিত্তিক আম প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হয়েছে।
· প্রশিক্ষণ: ৪০ হাজারেরও বেশি আমচাষি, রপ্তানিকারক, পরিবহনকারী ও বাজারজাতকারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
· আধুনিক কৃষিযন্ত্র: কৃষকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে হ্যান্ড স্প্রেয়ার, পাওয়ার স্প্রেয়ার, গার্ডেন টিলার, ম্যাংগো প্লাকারসহ নানা আধুনিক কৃষিযন্ত্র।
· জ্ঞান বৃদ্ধি: চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন জেলার চাষিরা এখন জানেন কখন আম তুললে তা রপ্তানিযোগ্য হয়, কতটুকু পেকে গেলে তা ইউরোপে রপ্তানির মানে পড়ে এবং কোন জাত রপ্তানির জন্য উপযুক্ত।
এই প্রকল্পের একটি অনন্য দিক হলো নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ। গ্রেডিং, প্যাকিং, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছে, যা শুধু উৎপাদন নয়, কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্রও তৈরি করছে।
প্রকল্পের অধীনে আম প্রক্রিয়াজাতকরণের ছোট প্লান্ট, ওয়াশিং-গ্রেডিং-কুলিং শেড এবং অনলাইনভিত্তিক বাজার সংযোগ প্ল্যাটফর্ম তৈরি হচ্ছে। রপ্তানির পাশাপাশি দেশের সুপারশপ ও পাঁচতারকা হোটেলেও মানসম্পন্ন এই আম সরবরাহ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে সরকার এই উদ্যোগ আরও বড় পরিসরে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
আমচাষি আব্দুল হান্নান বলেন, "আমরা আগে জানতাম না রপ্তানির জন্য আলাদা মানদণ্ড আছে। এখন জানি এবং সে অনুযায়ী চাষ করি।"
'রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের' পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান জানান, আম রপ্তানির ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যার মধ্যে বিমান ভাড়া স্থিতিশীল রাখা এবং বিমানের সংকট না হওয়া অন্যতম। এই বিষয়টি নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেছেন যে, সঠিক পরিকল্পনা, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং মাঠপর্যায়ের নিবিড় কার্যক্রম থাকলে কম বাজেটেও বিশাল পরিবর্তন আনা সম্ভব। আম রপ্তানি বাড়ার পাশাপাশি কৃষকের দৃষ্টিভঙ্গি, চাষাবাদের ধারা এবং বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান বদলে যাচ্ছে। তিনি এই উদ্যোগকে আরও বড় করার এবং যেসব এলাকায় আগে কখনও রপ্তানিমুখী চাষ হয়নি, সেখানেও চাষ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।