ধ্রুব নিউজ ডেস্ক
মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি গ্রামের রিমন শেখের গল্পটি কেবল একজন উদ্যোক্তার সাফল্যের গল্প নয়, এটি প্রতিকূলতা জয় করে স্বাবলম্বী হওয়ার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ২০১৯ সালে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে অর্থনীতি নিয়ে পড়ার সময় টিউশনি করে নিজের খরচ চালাতেন। কিন্তু ২০২০ সালের করোনা মহামারি সবকিছু ওলটপালট করে দেয়। টিউশনি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হতাশাগ্রস্ত না হয়ে তিনি বেছে নেন এক ভিন্ন পথ—জৈব সার উৎপাদন।
লকডাউনের সময় রিমন নিজ গ্রামে ফিরে আসেন এবং বিকল্প আয়ের পথ খুঁজতে থাকেন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শে এবং টিউশনি থেকে সঞ্চয় করা মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা বিনিয়োগ করে তিনি ছোট পরিসরে শুরু করেন ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরির প্রজেক্ট। তার এই উদ্যোগ ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং বর্তমানে এটি ৪০ লাখ টাকার একটি প্রকল্পে রূপান্তরিত হয়েছে। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করার পর এখন তিনি চাকরির পেছনে না ছুটে বরং অন্যদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছেন।
সদর উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আশরাফুল আলম জানান, জৈব সার মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়ায় এবং ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৬টি উপাদান ধারণ করে। রাসায়নিক সার যেখানে তাৎক্ষণিক ফল দিলেও দীর্ঘমেয়াদে মাটির ক্ষতি করে এবং পরবর্তীকালে দ্বিগুণ সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয়, সেখানে জৈব সার একবার ব্যবহার করলে অন্তত দু'বার সুফল পাওয়া যায়। এটি জমির স্বাস্থ্য ও প্রাণ সতেজ রাখে এবং দীর্ঘস্থায়ীভাবে মাটির উর্বরতা বাড়ায়। এ কারণেই কৃষকরা এখন জৈব সারের দিকে ঝুঁকছেন। রিমনের তৈরি ভার্মি কম্পোস্ট সার তার বাড়ি থেকেই কৃষকরা কিনে নিচ্ছেন।
রিমন জানান, করোনার সময় টিউশনি হারিয়ে তিনি হতাশ না হয়ে আয়-রোজগারের পথ খুঁজতে থাকেন। বাড়ির পাশে বাবার এক বিঘার আম বাগানে মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকার কেঁচো কিনে তিনি ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরি শুরু করেন এবং তার ফার্মের নাম দেন "সোনার বাংলা এগ্রো"। কৃষি বিভাগ তাকে সার তৈরির নানা কৌশল সম্পর্কে ধারণা দেয় এবং তিনি দক্ষতার সাথে প্রয়োজনীয় উপাদান সহ ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদনে সক্ষম হন। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে তার সার ঢাকার ল্যাবে পরীক্ষা করা হয় এবং পরীক্ষায় সব উপাদান বিদ্যমান প্রমাণিত হয়, যার ফলে তার সারের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়
রিমনের বাবা জমিরুল ইসলাম জানান, ছেলে এখন তাকে বাইরে কাজ করতে দেন না, বরং তার প্রকল্পের দেখাশোনা করেন। বর্তমানে তাদের প্রকল্পে চারজন নিয়মিত শ্রমিক কাজ করছেন। প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা লেবার খরচ, ৫০ হাজার টাকার গোবর এবং ১৫ হাজার টাকার বস্তা কিনতে হয়। বর্তমানে মাসে ২৫ টন ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন হচ্ছে, যা প্রতি টন ১২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এছাড়াও, কেঁচো চার হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সব খরচ বাদ দিলেও মাসে প্রায় এক লাখ টাকা আয় হচ্ছে। রিমনের এখন লক্ষ্য গোবর না কিনে গরু কেনা এবং গাভি ও ষাঁড় গরু কিনে আলাদা ফার্ম করা। তিনি সরকারি সহায়তা পেলে খুব দ্রুতই এই ফার্ম স্থাপন করতে পারবেন বলে আশা করছেন।
অনুপ্রেরণা ও কৃষি বিভাগের সহায়তারিমনের সফলতা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন উদ্যোক্তা সাইফুল ইসলামও ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরির প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন এবং বর্তমানে তিনি লাভজনক অবস্থায় আছেন। তিনি আশা করছেন, আর চার-পাঁচ মাস পর থেকে মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. সামসুল আলম বলেন, মেহেরপুর কৃষিতে সমৃদ্ধ একটি জেলা এবং জমির স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য জৈব সারের কোনো বিকল্প নেই। ভার্মি কম্পোস্ট সার ব্যবহারে জমির শক্তি ১০ গুণ বেড়ে যায় এবং রাসায়নিক সার ব্যবহারের মাত্রা কমানো যায়। রিমন শেখের মতো শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তার এই বাণিজ্যিক সাফল্য অন্যদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এ ধরনের তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।