❒ উচ্চকক্ষ গঠনের অনুমোদন দেবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ
ধ্রুব নিউজ ডেস্ক
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশ ২০২৫-এর খসড়া করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ভোটের অনুপাত (পিআর) পদ্ধতিতে আগামী সংসদে উচ্চকক্ষ গঠনে আদেশে বিশেষ শর্ত থাকবে। গণভোটে আদেশ পাস হলে সংবিধান সংস্কার পরিষদ উচ্চকক্ষ গঠনের অনুমোদন দেবে।
বিএনপি পিআরের ঘোর বিরোধী। জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল পুরো নির্বাচনে পিআর চাইলেও তারা এবং এনসিপি অন্তত উচ্চকক্ষে পিআরের দাবিতে অনড়। এই বিরোধ জুলাই সনদ বাস্তবায়নে প্রধান বাধা। তাই আদেশে পিআর নিয়ে সংকট সমাধানে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মতামতের সমন্বয় করা হয়েছে। ঐকমত্য কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, আদেশ গণভোটে পাস হলে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন অনুমোদনে সংবিধান সংস্কার পরিষদ বাধ্য থাকবে। অন্যান্য সংস্কারে পরিষদ ৯ মাস সময় পেলেও উচ্চকক্ষ গঠনে অগ্রাধিকার দেবে। অনুমোদনের ১৫ দিনের মধ্যে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হবে। আগামী সংসদেই পিআর পদ্ধতির উচ্চকক্ষ কার্যকরে আদেশে এই বিশেষ শর্তটি রাখা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। জুলাই সনদে থাকা অন্যান্য সংস্কারের সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক দলের নোট অব ডিসেন্টের (ভিন্নমত) বিষয়ে এমন শর্ত থাকছে না বলে জানা গেছে।
কমিশন সূত্র জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার সময় পাওয়া সাপেক্ষে আজ সোমবার আদেশের খসড়া এবং কার্যকরের সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে। তারা সরকারের কাছে দুটি বিকল্প সুপারিশ তুলে ধরবে। গতকাল রোববার সংসদ ভবনে কমিশনের কার্যালয়ে কমিশন এবং বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সভায় আদেশের খসড়া প্রণয়ন করা হয়। সূত্র জানিয়েছে, আজ সকালে কমিশনের সভায় খসড়ায় ভাষাগত কিছু পরিবর্তন আনতে পারে।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি সম্পর্কিত সুপারিশ চূড়ান্ত হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে সরকারপ্রধানের কাছে জমা দেওয়া হবে।
যা থাকছে আদেশে
কমিশন সূত্র জানায়, গণঅভ্যুত্থানের ক্ষমতাবলে আদেশ জারির সুপারিশ করা হবে। এই আদেশের ওপর গণভোট হবে। খসড়ায় বলা হয়েছে, আদেশ গণভোটে জনগণের অনুমোদন পেলে আগামী নির্বাচনে গঠিত সংসদ দ্বৈত ভূমিকা রাখবে। একটি হবে নিয়মিত সংসদ, যা সরকার গঠন এবং আইন ও বাজেট প্রণয়ন করবে। দ্বিতীয় ভূমিকা হলো– সংসদ সদস্যদের নিয়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন।
খসড়া আদেশে বলা হয়েছে, ৯ মাস বা ২৭০ দিনে জুলাই সনদ অনুযায়ী সংবিধানের সংস্কার, পরিমার্জন, সংশোধন করা নির্দেশনামূলক নয় বাধ্যতামূলক হবে পরিষদের জন্য। তবে এটা না করলে কী হবে, তা গতকাল রোববার রাত পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি।
গণভোট কখন হবে, আদেশ কে জারি করবে– এ-সংক্রান্ত সুপারিশ কমিশন করবে না বলে জানিয়েছে গতকাল রোববারের বৈঠক সূত্র। কমিশনের একাধিক সদস্য সমকালকে বলেছেন, এ দুই বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য না থাকায় সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পিআরের বিরোধ সুরাহার চেষ্টা
গত ১৭ অক্টোবর রাজনৈতিক দল স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে ৮৪ সংস্কারের সিদ্ধান্ত রয়েছে। এর মধ্যে ৯ মৌলিক সংস্কারের সিদ্ধান্তে বিএনপির ভিন্নমত রয়েছে। দলটি বলছে, ক্ষমতায় গেলে এগুলো বাস্তবায়ন করবে না। জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের দাবি, গণভোট অনুমোদন করলে পুরো সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে।
তবে দলগুলোর প্রধান মতবিরোধ পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন নিয়ে। বিএনপি এবং এনডিএম বাদে সংলাপে অংশ নেওয়া ২৫টি দল উচ্চকক্ষে পিআর চায়। তবে এটি নিয়ে গত চার মাসে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি দলগুলো। কমিশন সূত্র জানিয়েছে, জামায়াত, এনসিপিসহ কিছু দল বলছে, পিআর বাদ দিলে নির্বাচন বর্জন করতে পারে তারা। বিএনপির সমমনা কিছু দলও পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ চায়।
বিএনপি বলেছে, নির্বাচনে জয়ী দল নোট অব ডিসেন্ট অনুযায়ী সংস্কার করতে পারবে। বিএনপির দাবিতে স্বাক্ষরের আগের দিন সনদে এই অংশ যোগ করা হয়। বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন সদস্য সমকালকে বলেছেন, মূল অনৈক্য উচ্চকক্ষে পিআরে নোট অব ডিসেন্ট।
একজন বিশেষজ্ঞ সমকালকে বলেছেন, সংবিধানের সুরক্ষায় উচ্চকক্ষে পিআর প্রয়োজন। কিন্তু বিএনপিকে উপেক্ষা করে তা চাপিয়ে দিলে সংস্কার ভন্ডুল হবে। দলটি সংসদে পিআরের সুরাহা চায়। অন্যান্য দল বলছে, গণভোটে আদেশ পাস হলেই উচ্চকক্ষে পিআর হবে। মাঝামাঝি পথ হিসেবে খসড়ায় রাখা হয়েছে, গণভোটের পর পরিষদে অনুমোদিত হলে উচ্চকক্ষে পিআর হবে। এর মাধ্যমে বিএনপির অবস্থানকে গ্রহণ করা হয়েছে। পরিষদে উচ্চকক্ষ গঠনের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করে অন্যদের দাবিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পরিষদ ঠিক করবে কীভাবে উচ্চকক্ষের সদস্যরা নির্বাচিত হবেন।
অভ্যুত্থানের ক্ষমতাবলেই আদেশ
বিএনপি সংলাপে বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সর্বোচ্চ আদালতের মতামতে গঠিত। সংবিধান এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রয়েছে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক আদেশ জারির ক্ষমতা নেই। জামায়াত এবং এনসিপি এই অবস্থানের বিরোধী। আদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ব্যক্ত করা জনগণের কর্তৃত্বে আদেশ জারি করা হচ্ছে।’
জামায়াত এবং এনসিপির দাবি, আওয়ামী লীগ মনোনীত রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন নন, আদেশ জারি করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নামে। বিএনপি আদেশে জারিরই বিরোধী। দলটির অবস্থান হলো, বিদ্যমান আইনে প্রজ্ঞাপন জারি করে জুলাই সনদের ওপর গণভোট হতে পারে।
কমিশন সূত্র জানিয়েছে, জুলাই সনদ নয়, গণভোট হবে আদেশের ওপর। আদেশ কে জারি করবে, তা সরকার নির্ধারণ করবে। গণভোটে একটি প্রশ্ন থাকবে। সম্ভাব্য প্রশ্ন হবে, ‘আপনি কি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশ এবং সংস্কারকে সমর্থন করেন’? গণভোটে নোট অব ডিসেন্ট থাকবে না। বিশেষজ্ঞরা গতকালের বৈঠকেও বলেছেন, নোট অব ডিসেন্ট রেখে সংস্কার হবে না।
৯ মাসে বাস্তবায়ন না হলে কী
সংস্কার ৯ মাসে বাস্তবায়ন করতে না পারলে সংসদ বাতিল কিংবা জুলাই সনদ অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধান সংস্কারের আলোচনা হলেও আদেশে তা রাখা হয়নি। আরেকটি আলোচনা ছিল, সংসদের আগে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ গঠন হবে। সংস্কারের পর তা সংসদে রূপ নেবে। তখন সরকার গঠিত হবে। সেটাও আদেশে থাকছে না।
কমিশন সূত্র জানিয়েছে, আদেশে বলা হবে, জুলাই সনদে যেভাবে রয়েছে, সেভাবেই সংবিধান সংস্কারে বাধ্য থাকবে পরিষদ।
কমিশন সূত্র জানিয়েছে, সরকারকে সুপারিশ দেওয়ার পর তা রাজনৈতিক দলগুলোকেও জানানো হবে। ভাষা এবং ভাবগত কোনো পরিবর্তন প্রয়োজন হলে, তা আগামী ৩১ অক্টোবর কমিশনের মেয়াদপূর্তির আগেই সম্পন্ন করা হবে।
বিএনপি নির্বাচনের দিনে এবং জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপি নির্বাচনের আগে গণভোট দাবি করছে। কমিশন সূত্র জানিয়েছে, এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার এবং নির্বাচন কমিশন। আদেশে গণভোটের সময় উল্লেখ থাকবে না।
শেষ সময়ে সমঝোতার চেষ্টা
আদেশ কার্যকরের প্রক্রিয়া সরকারের ওপর ছেড়ে দেবে কমিশন। কমিশন এবং বিশেষজ্ঞ প্যানেলের একাধিক সদস্য সমকালকে বলেন, আদেশ জারি করে তা কার্যকরে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
এতে রাজনৈতিক দলের সমর্থন আদায়ে গতকাল শেষ সময়ে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে কমিশন। বিএনপিকে উচ্চকক্ষে পিআর, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন পদ্ধতি মেনে নিতে অনুরোধ করা হয়। তবে অবস্থান পরিবর্তনের আভাস মেলেনি।
গতকাল কমিশনের সঙ্গে সভায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন বিচারপতি এম এ মতিন, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ অ্যাডভোকেট শরিফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন। আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে বৈঠকে অংশে নেন কমিশন সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন, মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।