❒ ভ্যাকসিন
ধ্রুব নিউজ ডেস্ক
ভ্যাকসিন মানব ইতিহাসে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর একটি। এটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে, প্রাণঘাতী রোগ নিয়ন্ত্রণে এনেছে। এ নিয়ে লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব
মানব ইতিহাসে অসংখ্য রোগ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। মহামারীর ভয়ে সভ্যতা বারবার থমকে গেছে। এর ভেতর থেকে ভ্যাকসিন আবিষ্কার মানুষের জীবনে এক নতুন যুগ এনেছে। ভ্যাকসিন মানে শুধু ওষুধ নয়, এটি হলো এক ধরনের প্রতিরোধ-ব্যবস্থা, যা শরীরকে আগেভাগেই রোগের বিরুদ্ধে প্রস্তুত করে। আজকের দিনে ছোট্ট একটি ইনজেকশন বা ড্রপকে আমরা স্বাভাবিক মনে করি, কিন্তু এর পেছনে রয়েছে শত শত বছরের পরীক্ষা, গবেষণা এবং সংগ্রামের ইতিহাস।
গুটিবসন্ত ও ভ্যাকসিনের জন্ম
ভ্যাকসিনের ইতিহাস শুরু হয় গুটিবসন্তকে ঘিরে। গুটিবসন্ত ছিল একটি ভয়াবহ রোগ, যা হাজার বছর ধরে কোটি কোটি মানুষ হত্যা করেছে। ভ্যাকসিনের ইতিহাস শুরু হয় মানবজাতির এক ভয়াবহ শত্রু গুটিবসন্ত থেকে। হাজার বছরের পুরনো এই রোগ বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ হত্যা করেছে। প্রাচীন মিসরীয় মমি, চীনা গ্রন্থ এমনকি ভারতের লেখাতেও গুটিবসন্তের বর্ণনা পাওয়া যায়। রোগটি এতটাই মারাত্মক ছিল যে, আক্রান্তদের অধিকাংশই মারা যেত, আর যারা বেঁচে যেত তাদের শরীর জুড়ে স্থায়ী দাগ রয়ে যেত। আধুনিক ভ্যাকসিনের ধারণা আসে ১৮শ শতকের ইংল্যান্ডে। গ্রামীণ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার লক্ষ্য করেন, যারা একবার কাউপক্সে আক্রান্ত হয়েছে, তারা আর মানুষের গুটিবসন্তে আক্রান্ত হচ্ছে না। কারণ, দুটো রোগের জীবাণু এক ধরনের হলেও মানুষের গুটিবসন্ত বেশি শক্তিশালী আর ভয়ংকর। শরীরে যখন কাউপক্স ঢোকে, তখন প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। সেই প্রতিরোধ ক্ষমতা পরবর্তীতে আসল গুটিবসন্তের জীবাণুকেও ঠেকাতে পারে।
এই পর্যবেক্ষণ থেকেই জেনারের মাথায় এলো ধারণা মানুষকে ইচ্ছে করে কাউপক্সে আক্রান্ত করলে হয়তো গুটিবসন্ত থেকে বাঁচানো যাবে। তিনি পরীক্ষায় ছেলেটির শরীরে কাউপক্সের জীবাণু প্রবেশ করান। ছেলেটি হালকা অসুস্থ হয়, কিন্তু মারাত্মক কিছু হয়নি। পরে যখন তাকে আসল গুটিবসন্তের জীবাণুর সংস্পর্শে আনা হলো, তার শরীর প্রতিরোধ তৈরি করে এবং সে অসুস্থ হলো না। এভাবেই বোঝা গেল, দুর্বল রোগ (কাউপক্স) শরীরে ঢুকলে শরীর শিখে নেয় কীভাবে শক্তিশালী রোগের (স্মলপক্স) বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। আর এই ধারণাই আধুনিক ভ্যাকসিনের ভিত্তি। জেনারের এই আবিষ্কার দ্রুতই ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে অনেকেই সন্দেহ করেছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে এটি গ্রহণযোগ্যতা পায়। ধীরে ধীরে টিকাদান কর্মসূচি চালু হয় এবং একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ^ জুড়ে কোটি কোটি মানুষকে গুটিবসন্তের টিকা দেওয়া হয়। অবশেষে দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা করে গুটিবসন্ত পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ নির্মূল হয়েছে। এটি আজও মানবজাতির সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য সাফল্য হিসেবে ধরা হয়।
উনিশ ও বিশ শতকে ভ্যাকসিনের বিস্তার
এডওয়ার্ড জেনারের হাত ধরে ভ্যাকসিনের যাত্রা শুরু হলেও উনিশ শতকেই ভ্যাকসিন বিজ্ঞানে বড় পরিবর্তন আসে। ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর এ সময় ভ্যাকসিন গবেষণাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। তিনি আবিষ্কার করেন, রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে যদি দুর্বল বা নিষ্ক্রিয় করে শরীরে প্রবেশ করানো যায়, তাহলে শরীর আসল রোগের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। এই ধারণার ভিত্তিতেই তিনি তৈরি করেন অ্যানথ্রাক্স ও জলাতঙ্ক (রেবিজ)-এর ভ্যাকসিন। বিশেষ করে ১৮৮৫ সালে একটি শিশুকে জলাতঙ্কের টিকা দিয়ে বাঁচানোর ঘটনা বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন তোলে এবং ভ্যাকসিনকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের মূলধারায় নিয়ে আসে। এরপর ধীরে ধীরে অন্যান্য রোগের ভ্যাকসিন তৈরি হতে থাকে। ডিফথেরিয়া, টিটেনাস, হুপিং কাশি (পার্টুসিস)-এর মতো রোগের ভ্যাকসিন উনিশ শতকের শেষ ভাগ ও বিশ শতকের শুরুতে তৈরি হয়। একসময় শিশুদের মধ্যে এই রোগগুলোতে মৃত্যুহার ছিল খুব বেশি। ভ্যাকসিন চালু হওয়ার ফলে এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে আসে। একই সময়ে বিসিজি (BCG) ভ্যাকসিন তৈরি হয়, যা যক্ষ্মা (টিবি) প্রতিরোধে ব্যবহার করা হয়। বিশ শতকের মাঝামাঝি আসে ভ্যাকসিন ইতিহাসের আরেকটি বড় সাফল্য পোলিও ভ্যাকসিন। পোলিও এমন একটি রোগ, যা শিশুদের স্থায়ীভাবে পঙ্গু করে দিতে পারত। ১৯৫০-এর দশকে বিজ্ঞানী জোনাস সাল্ক ইনজেকশনের মাধ্যমে পোলিও ভ্যাকসিন তৈরি করেন। কয়েক বছর পর আলবার্ট সাবিন মুখে খাওয়ার টিকা তৈরি করেন, যা আরও সহজে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। বিশ্ব জুড়ে শিশুদের জন্য ব্যাপকভাবে পোলিও টিকা চালু হয় এবং আজ অধিকাংশ দেশ থেকে এই রোগ প্রায় নির্মূল হয়ে গেছে।
বিশ শতকেই তৈরি হয় ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন, হাম (মিজলস), কণ্ঠমালা (মাম্পস) এবং রুবেলা-এর টিকা। অনেক দেশে এগুলো একসঙ্গে এমএমআর (Measles–Mumps–Rubella) নামে শিশুদের দেওয়া হয়। এর ফলে আগে শিশুদের মধ্যে ব্যাপক মৃত্যুর কারণ হওয়া রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে আসে।
এ সময় ভ্যাকসিন শুধু বৈজ্ঞানিক সাফল্যই ছিল না, বরং রাষ্ট্রের নীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘ÔExpanded Program on Immunization (EPI)’ শুরু করে, যার লক্ষ্য ছিল শিশুদের নিয়মিত টিকাদান নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে এই কর্মসূচি শুরু হয় ১৯৭৯ সালে এবং এর ফলে শিশু মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে।
উনিশ ও বিশ শতকের এই সময়কালকে তাই বলা যায় ভ্যাকসিন বিস্তারের সোনালি যুগ। এই সময়েই টিকা জনস্বাস্থ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায় এবং আধুনিক চিকিৎসার অন্যতম ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
কভিড-১৯ ও ভ্যাকসিনের ভবিষ্যৎ
২০২০ সালে কভিড-১৯ মহামারী শুরু হলে বিশ্ব আবারও ভ্যাকসিনের দিকে তাকায়। মাত্র এক বছরের মধ্যে একাধিক ভ্যাকসিন তৈরি হয়, যা ইতিহাসে নজিরবিহীন। ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, সিনোভ্যাক, স্পুটনিক বিভিন্ন ভ্যাকসিন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এবার ব্যবহৃত প্রযুক্তিও ছিল নতুন। এমআরএনএ ভ্যাকসিন
প্রথমবারের মতো ব্যাপকভাবে মানুষের শরীরে ব্যবহার হলো। এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে ক্যানসার বা অন্যান্য জটিল রোগের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরির সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। কভিড-১৯ ভ্যাকসিন বিশ্বকে দেখিয়েছে, বিজ্ঞানীরা যখন সমন্বিতভাবে কাজ করেন, তখন অভূতপূর্ব গতিতে সমাধান বের করা সম্ভব। তবে একই সঙ্গে মহামারী দেখিয়েছে, ভ্যাকসিন পাওয়া ও বণ্টনে বৈষম্য কতটা গুরুতর। ধনী দেশগুলো দ্রুত ভ্যাকসিন সংগ্রহ করেছে, কিন্তু দরিদ্র দেশগুলো পিছিয়ে পড়েছে।
ভবিষ্যতে ভ্যাকসিন শুধু সংক্রামক রোগ নয়, ক্যানসার, অ্যালার্জি বা এমনকি এইচআইভির মতো রোগ প্রতিরোধেও ব্যবহৃত হতে পারে। গবেষকরা জিন প্রকৌশল ও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরও কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছেন।
ভ্যাকসিন নিয়ে বিতর্ক ও চ্যালেঞ্জ
ভ্যাকসিনের সাফল্য যত বড় হয়েছে, ততবারই এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব ছড়িয়েছে। উনিশ শতকেই ইংল্যান্ডে যখন গুটিবসন্তের টিকা দেওয়া শুরু হয়, তখন অনেকেই বলেছিল এই টিকা মানুষকে অসুস্থ করে তুলবে কিংবা এটি ‘ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরোধিতা’। সময়ের সঙ্গে এসব ভয় নানারূপে আবার ফিরে আসে।
আধুনিক যুগে ভ্যাকসিন বিরোধিতার সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। সেখানে অনেকে দাবি করেছে, ভ্যাকসিন শিশুদের অটিজম ঘটায়, যদিও এ বিষয়ে প্রকাশিত গবেষণাটি পরে প্রমাণিত হয় ভুয়া এবং লেখক নিজে চিকিৎসক হিসেবে তার লাইসেন্স হারান। তবুও এই গুজব এখনো বহু মানুষ বিশ্বাস করে। কভিড-১৯ মহামারীর সময় আবার নতুন ধরনের ষড়যন্ত্র ছড়ায় : ভ্যাকসিনে নাকি মাইক্রোচিপ ঢোকানো হচ্ছে, যাতে মানুষকে ট্র্যাক করা যায়; বা এটি নাকি পশ্চিমা দেশগুলোর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা।
ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার কিছু এলাকায়ও ভ্যাকসিন নিয়ে ভয় ছড়ানো হয়েছে। অনেক ধর্মীয় নেতা বা গোষ্ঠী দাবি করেছে, ভ্যাকসিন নিলে বন্ধ্যত্ব হবে বা এটি কোনো বিদেশি ষড়যন্ত্র। এই গুজবের কারণে টিকাদান কর্মসূচি ব্যাহত হয়েছে, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে।
বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পরিষ্কার ভ্যাকসিন নিরাপদ এবং কার্যকর। কিন্তু ভয় ও গুজব ছড়ানো সহজ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফলে অনেক মানুষ টিকা নিতে দেরি করে বা একেবারেই এড়িয়ে যায়, যার ফলে প্রতিরোধযোগ্য রোগ আবার ছড়াতে শুরু করে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে কিছু অ্যান্টিভ্যাক্সার কমিউনিটির কারণে হাম (মিজলস) আবার ফিরে এসেছে।
ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব আসলে মানুষের অজানার ভয়কে কাজে লাগায়। যখনই নতুন কোনো রোগ আসে আর দ্রুত সমাধান দেওয়া হয়, তখনই সন্দেহ জাগে। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে ভ্যাকসিনের মাধ্যমে কোটি কোটি প্রাণরক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। তাই ভ্যাকসিনবিরোধী গুজব কেবল বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে থামিয়ে দেয় এবং সমাজকে আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো দারিদ্র্য ও বৈষম্য। উন্নত দেশে যেখানে ভ্যাকসিন সহজলভ্য, উন্নয়নশীল দেশে তা অনেক সময় পাওয়া যায় না। টিকা সংরক্ষণ, পরিবহন, প্রশিক্ষিত কর্মী এসবের অভাবে টিকাদান কর্মসূচি ব্যাহত হয়। ফলে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য এখনো অসম। ভ্যাকসিন মানবজাতির জন্য এক বিশাল আশীর্বাদ। এটি কোটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে, অসংখ্য রোগকে নিয়ন্ত্রণে এনেছে। গুটিবসন্ত নির্মূল থেকে শুরু করে পোলিও হ্রাস, আর সর্বশেষ কভিড-১৯ ভ্যাকসিন আমাদের দেখিয়েছে, বিজ্ঞান ও সমন্বিত প্রচেষ্টা মানবজাতিকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে। ভ্যাকসিনের ইতিহাস একদিকে বিজ্ঞানীদের অবিশ্বাস্য সৃজনশীলতার গল্প, অন্যদিকে মানুষের ভীতি, বিতর্ক এবং অসমতার প্রতিফলন। তবুও নিশ্চিতভাবে বলা যায় যতদিন নতুন নতুন রোগ আসবে, ততদিন ভ্যাকসিন মানব সভ্যতার অস্ত্র হিসেবে রয়ে যাবে।