সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
Ad for sale 100 x 870 Position (1)
Position (1)

বৃষ্টি, প্রেম ও প্রকৃতির ইশারা

ধ্রুব নিউজ ডেস্ক ধ্রুব নিউজ ডেস্ক
প্রকাশ : শুক্রবার, ১১ জুলাই,২০২৫, ১১:২৮ পিএম
বৃষ্টি, প্রেম ও প্রকৃতির ইশারা

সেই কবে জার্মানিতে, বন শহরের এক থেরাপি সেন্টারে দেখা হয়েছিল আলেকজান্ডারের সাথে। অফিস শেষে বিকেলের থেরাপি স্লটে প্রায়শই তার সঙ্গে দেখা হতো। আমার থেকে ছয় বছরের ছোট হলেও, সে আমাকে দেখে ১৮-২০ বছরের ইন্ডিয়ান স্টুডেন্ট ভাবত। যখন ২৮ বছর বয়সের কথা জানাই, তার বিস্ময় ছিল দেখার মতো – "হোয়াট! টোয়েন্টি এইট! ইউ আর আ ওমেন!" তার এই সরল প্রকাশে আমি হেসে ফেলি। একদিন সকালে প্রথম স্লটে তাকে দেখে অবাক হই। সে জানাল, সহকর্মীর প্রয়োজনে তার শিফট কাভার করছে।

আমার থেরাপির এক পর্যায়ে আলেকজান্ডার জানাল, পরের ক্লায়েন্ট না আসায় সে আমাকে অতিরিক্ত সময় দেবে। সে অফার করল আমার মাথায় ম্যাসাজ করে দেবে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, "আর ইউ শিওর!" সে হেসে বলল, "হোয়াই নট! আজকে আমি গুড মুডে আছি।

চোখ বন্ধ করে তপ্ত বিছানায় শুয়ে যখন আলেকজান্ডার মাথায় ম্যাসাজ করছিল, তখন বৃষ্টি নিয়ে কথা উঠল। সে জানাল, ইন্ডিয়ায় প্রচুর বৃষ্টি হয় বলে সে সেখানে যেতে চায়। আমি তখন ওকে বাংলাদেশের বর্ষার কথা বললাম – একটানা তিন-চার-পাঁচ দিন ধরে মুষলধারে, ধীর বা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির গল্প। বললাম গাদলার কথা, বর্ষার ফুলের কথা। বৃষ্টির দিনে চাল ভাজা, চিড়া ভাজা, বুট, বাদাম, খিচুড়ি, পেঁয়াজ-শুকনো মরিচের ভর্তার মতো নানান মুখরোচক খাবারের কথা।

বৃষ্টিতে দলবেঁধে ছেলে-বুড়োদের হুটোপুটি করে ভেজার গল্প শুনে আলেকজান্ডার মুগ্ধ। শৈশবে বৃষ্টি নামানোর জন্য ব্যাঙের বিয়ে দেওয়ার কথাও বললাম। আমার কথা তার কাছে যেন রূপকথার গল্প মনে হচ্ছিল। "তোমাদের কী সৌভাগ্য! কত বৃষ্টি হয় তোমাদের দেশে!" – তার বিস্ময় ছিল গভীর। আমি ওকে বললাম, "বৃষ্টি দেখতে হলে কোনো এক মুনসুনে তুমি এসো বাংলাদেশে।"

সেই ঘনঘোর বরিষায়, আমার পিঠের নিচে উষ্ণতা আর মাথায় আলেকজান্ডারের পেলব ম্যাসাজের মাঝে মনটা যেন বাংলার বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথের সেই গান মনে পড়ল, 'এমন দিনে তারে বলা যায়/ এমন ঘনঘোর বরিষায়।' সেদিনের বৃষ্টি ছিল মন পেলব করা এক অনুভব।

সেই দিন থেরাপি শেষে শহরে ম্যাকডোনাল্ডসে খেয়ে, ফুল কিনে ডর্মে ফেরার পথে হঠাৎ আমার ব্যাঙের ডাক শুনতে আর কদমের ঘ্রাণ পেতে ইচ্ছে হলো। এই প্রথম মনে হলো, ব্যাঙ কী মিষ্টি-গভীর-মন্দ্রসুরে ডাকে: ‘মেঘ অ, মেঘ অ’! ছোটবেলায় বৃষ্টির আগে-পরে ‘গতা’ ব্যাঙের দল পাড়াজুড়ে এমন ডাকত। আমরাও তাদের নকল করে ডাকতাম।

বৃষ্টি আর নদী বাংলার খানা-খাদ্য-চাষ-কৃষি-ধর্ম-দর্শন তথা বাঙালির চিরায়ত চরিত্র থেকে অবিচ্ছেদ্য। বৃষ্টি ছাড়া বাংলার কবিদেরও কল্পনা করা যায় না। 'আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে' মন আকুল হয়, হৃদয়ে জমা কথার ভার হালকা হয়। আষাঢ়-শাওন-ভাদরে বৃষ্টির ঝমঝম ধ্বনি যেন মানুষের মনের সব ক্লেদ ধুয়ে মুছে দেয়। ভারতীয় দর্শনে জন্মান্তরবাদ ও শক্তির অবিনশ্বরতার কথা যেমন আছে, তেমনি বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা যেন বাঁচা-মরার এক রহস্যময় ইশারা। জলীয় বাষ্প হয়ে ঊর্ধ্বাকাশে উড়ে যাওয়া জলবিন্দুরা আবার নিজেদের ভারে মেঘ হয়ে ভেঙে পড়ে বারিধারায়, যা শস্য ও বীজের ভেতর দিয়ে আবার ফিরে আসে। এভাবেই চক্রাকারে বারবার মরে গিয়ে সে নিজেকে বাঁচায়। বৃষ্টি যেন যৌথতা রচনার এক নীরব তাগিদ, যা মানুষের মনকে নাড়া দেয় – চেনা জীবনের হিসাব ভন্ডুল করে দিয়ে তুমুল প্রেমের বোধ জাগায়।

শৈশবে বৃষ্টি ছিল আমার প্রিয় সঙ্গী। সারাদিন ভিজতাম, চোখ লাল ও ঠোঁট নীল করে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতাম। দাদু ভয় দেখাতো, "আজজ্যোয়া তোরে মাইরে টানছে!" কিন্তু বড় হতে হতে বৃষ্টি-প্রিয় সেই আমিই হয়ে উঠলাম বৃষ্টি-বিদ্বেষী, বিশেষ করে ঢাকায় আসার পর। আমার জন্মের দিন, বিয়ের দিন—সবকিছুতেই বৃষ্টি যেন আমার পিছু ছাড়ে না, তাই 'বৃষ্টি রাশি' বলে দুর্নামও ছিল। এই বিদ্বেষ একদিন আমাকে ভাবিয়ে তুলল। নিজের 'পোস্টমর্টেম' করে বুঝলাম, বৃষ্টি নয়, বৃষ্টির পরের বিড়ম্বনাটাই আমাকে বিরক্ত করত। ঠিক যেন আত্মহননের মতো, যেখানে ব্যক্তি ব্যথা থেকে মুক্তি চায়, জীবন থেকে নয়। এই উপলব্ধির পর আমি আমার পুরাতন বৃষ্টির প্রতি ভালোবাসায় ফিরে আসি।

এরপরের গল্পটা খাগড়াছড়ির। আমি ও আমার বর, টোনা আর টুনি সেজে সাজেক যাওয়ার পরিকল্পনা করি। গিরিস্বর্গে সন্ধেবেলায় হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি নামল, যেন মা প্রকৃতির উপহার। টোনার চাঁদ দেখতে না পাওয়ার খেদ হলেও টুনি বলল, "মা যা দিয়েছেন, তাই নাও অঞ্জলি ভরে।" বৃষ্টি দেখতে দেখতে, গল্প-খুনসুটিতে রাত গভীর হলো। রাত প্রায় আড়াইটার দিকে বৃষ্টি থামলে, মেঘে ঢাকা জোছনার মায়াখেলা দেখে টোনা টুনিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। জনমানবহীন রাতের পাহাড়ে, বৃষ্টিধোয়া বাতাসে, মেঘভাঙা চাঁদের আলোয় তারা হাত ধরে চুপচাপ হাঁটলো।

আবার হঠাৎ বৃষ্টির উপক্রম হলে তারা দৌড়ে বারান্দায় ফিরল। অলিন্দে বসতেই এক আদিগন্ত বিস্তৃত মেঘের চাঁই তাদের দিকে আসতে থাকল। মেঘ এসে বারান্দায় বসা টোনা আর টুনিকে আদরে মুড়ে দিল, যেন সাদা এক হাওয়াই মিঠাই। শীতল পরশ দিয়ে পুব থেকে মেঘ এসে গিরিকুটির ছাপিয়ে পশ্চিমে চলে গেল। মেঘের পরশে তনু-মন-অন্তরাত্মা বরফ-শীতল হলো। মেঘের চুমু খেয়ে চলে যাওয়ার পর আকাশে বড় চাঁদ উদিত হলো এবং তার কিরণে শেষরাতে দুনিয়া ভেসে গেল। আদতে, মা প্রকৃতি টোনা আর টুনির জন্য বৃষ্টি নয়, বরং বিস্ময়কর এই মেঘ-জোছনার উপহার নিয়ে এসেছিলেন।

ধ্রুব নিউজের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

💬 Comments

Login | Register
Ad for sale 225 x 270 Position (2)
Position (2)