সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
Ad for sale 100 x 870 Position (1)
Position (1)

মাইকেল মধুসূদন দত্ত: বিদ্রোহ, প্রেম ও বাংলা সাহিত্যের রাজমুকুট

ধ্রুব নিউজ ডেস্ক ধ্রুব নিউজ ডেস্ক
প্রকাশ : শুক্রবার, ১১ জুলাই,২০২৫, ১১:২৩ পিএম
মাইকেল মধুসূদন দত্ত: বিদ্রোহ, প্রেম ও বাংলা সাহিত্যের রাজমুকুট

তামাটে বর্ণের মাইকেল মধুসূদন দত্ত, যাঁর চারপাশের মানুষজনের সাথে রূপ বা রঙের কোনো সাযুজ্য ছিল না, যাঁর নেতানো-এলানো কিছুই ভালো লাগত না, এমনকি স্বধর্ম হিন্দুত্বেও আস্থা হারিয়ে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন—সেই তিনিই বাংলা সাহিত্যের আকাশে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হয়ে আজও ভাস্বর। তাঁর মনের গভীরে লুকানো ছিল অবাধ, অগাধ, বিপুল কল্পনা ও কাব্যপ্রতিভা। উনিশ শতকের ষাটের দশকে বাঙালি-সংস্কৃত কবিদের কবিতায় ভালো লাগার জন্ম নিলেও, শেষ পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় কবিতা লেখার আগ্রহ জন্মেছিল তাঁর। অথচ, ভাগ্যের কী লীলা! সেই ইংরেজ কবিদের পরামর্শেই তিনি ফিরে এলেন আপন ভাষায়, বুঝতে পারলেন নিজের অপরিমেয় ভুল ও অপূরণীয় ক্ষতির কথা। এই সর্ববিদিত কথাগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাংলা ভাষার একজন মহাকবি, মহাবিদ্রোহী, মহান স্রষ্টা ও মহান সংস্কারকের পরিচয়।

যুগান্তকারী সৃষ্টি: ছন্দ ও ভাবের বিপ্লব
মধুসূদন দত্তের অমর কীর্তি 'মেঘনাদবধ কাব্য' বাংলা মহাকাব্যের সূচনা করে। এটি কেবল একটি কাব্যগ্রন্থ ছিল না, এটি ছিল চিরাচরিত ছন্দ ও পুরাণকথা ভেঙে এক স্বপ্রবর্তিত অমিত্রাক্ষর ছন্দের রচনা রীতি। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বৈচিত্র্যহীন অন্ত্যমিলপ্রধান কবিতার মুখোমুখি হয়ে তিনি ভেঙে দিলেন ছন্দ প্রকরণের চিরাচরিত নিয়ম। যেখানে অন্ত্যমিল নেই, কথা বলার সীমাবদ্ধতা নেই, দুটিমাত্র বাক্যে পূর্ণাঙ্গ ভাব প্রকাশের বাড়াবাড়ি নেই। একই সাথে তিনি ঝুলে পড়া, গড়পড়তা ভাষাকে চ্যালেঞ্জ করে নিয়ে এলেন ভাষার ও বক্তব্যের গাম্ভীর্য। তাঁর হাতেই নতুন রবির নতুন আলোয় ঝলসে উঠল বাংলা কবিতা, মহাকাব্য, নাটক, প্রহসন, গীতিকাব্য—সবকিছু।

ইতালীয় কবি পেত্রার্কের সনেট অনুসরণ করে মধুসূদন শুরু করলেন বাংলা চতুর্দশপদী কবিতাবলি। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলো ১০২টি বৈচিত্র্যপূর্ণ সনেট। যেখানে কবিতা ছিল দেবদেবীর উপাসনা, রাজরাজড়ার স্তুতি আর নিবেদনে ভরা, সেখানে তিনি কবিতাকে টেনে আনলেন মানব কীর্তনের ধারায়, মানবমনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার বিপুল স্রোততটে। তিনি শুরু করলেন মানুষের কথা, কুসংস্কারের বিরোধিতা, প্রেম ও প্রহসনের রকমারি।


বহুমাত্রিক জ্ঞান ও দেশপ্রেমের অনন্য প্রকাশ
কবি হওয়ার জন্য মধুসূদন আশ্রয় নিয়েছিলেন বহু ভাষার। অন্তত ১৩টি ভাষা তিনি আত্মস্থ করেছিলেন সেসব ভাষার সাহিত্যের রসাস্বাদনের জন্য এবং বহু বিচিত্র নির্যাসে বাংলা সাহিত্যকে ভরিয়ে তোলার জন্য। বাস্তবিকই তাঁর এই বিচিত্র পঠন-পাঠন আর বহু ভাষার সাহিত্যের আলোয় বাংলা কবিতাকে আলোকিত করেছিলেন। এমনকি তাঁর মা তাঁকে শৈশবে মক্তবে পাঠিয়ে আরবি-ফারসি ভাষাও শিখিয়েছিলেন, যা একটি পরিবারের উদারতা ও সংস্কারমুক্ততার পরিচয় বহন করে। মধুসূদন কথা রেখেছিলেন; বাংলা সাহিত্যের দরবারে তিনি সত্যি সত্যিই রাজমুকুট অর্জন করেছিলেন। তিনিই আমাদের প্রথম আধুনিক কবি, যিনি প্রচলিত সাহিত্যধারা ভেঙে নির্মাণ করেছেন স্বতন্ত্র পথ। ভাষার অলংকার ও তাতে গভীরতা আনয়নে তাঁর তুলনা নেই।

তাঁর পূর্বসূরিদের যখন ধর্মের স্তুতি আর দেবদেবীর বন্দনা ছিল নিয়তি, তখনই তিনি প্রথম আঘাত এনেছিলেন দেশপ্রেমে ব্রতী হয়ে। তাঁর প্রকৃতিপ্রেমের মাহাত্ম্য ছিল অসীম ও অতুলনীয়। তাঁর বিবিধ কাব্য, নাটক, গীতিকাব্যে প্রকৃতির বর্ণনা এলেও, অনন্য গ্রন্থ 'চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী'-তে অধিক মাত্রায় প্রকাশিত হয় দেশাত্মবোধের কথা। এই গ্রন্থে তিনি প্রেম, বিরহ ও প্রকৃতি বন্দনায় মেতে ওঠেন এবং দেশি-বিদেশি কৃতীজনদের নিয়েও রচনা করেন একের পর এক সনেট।

১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে (১২৭২ বঙ্গাব্দ) প্রথম প্রকাশিত মাইকেলের 'চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী'-র ভূমিকায় সম্পাদক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস লেখেন, এই সনেটগুলোতে মধুসূদনের অপূর্ব দেশপ্রেম, বিশেষত মাতৃভূমি বাংলাদেশের প্রতি তাঁর ঐকান্তিক ভালোবাসা ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে, যার তুলনা বাংলা সাহিত্যে বিরল। ১০২টি সনেটের মধ্যে বেশিরভাগই স্বদেশীয় বিষয় ও প্রকৃতির বর্ণনাসম্বলিত, যা সুদূর ফ্রান্সের ভার্সাই নগরে বসে লেখা হয়েছিল।


প্রবাসের টান, বাংলার প্রতি টান
দেশ ছেড়ে প্রবাসের জীবন তাঁকে বারবার কাছে টানলেও তিনি কখনও বিদেশি হতে পারেননি। প্রথম স্ত্রী রেবেকা ও দ্বিতীয় স্ত্রী হেনরিয়েটা—উভয়েই বিদেশি হওয়ার কারণে পারিবারিক জীবনে তাঁকে ইংরেজিতে বেশি কথা বলতে হলেও, তাঁর হৃদয়জুড়ে তখন ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার প্রকৃতি আর বাংলা ভাষার দ্যুতি। তাঁর ২৩ নম্বর সনেটে বাংলার প্রকৃতিমুগ্ধতা যেন উতলে উঠেছে।

পরদেশে আসক্ত হয়ে, পরধনে লোভী হয়ে বহুদেশ ভ্রমণ করলেও তিনি বাংলা ভাষা ও স্বদেশীয় মমত্বকে উপেক্ষা করতে পারেননি। তাঁর হৃদয়জুড়েই দু’কূল প্লাবিত করে আছড়ে পড়ছিল কপোতাক্ষ নদ। যে কারণে সুদূর ফ্রান্সে বসেই এই চতুর্দশপদী কবিতাগুলো লেখা সম্ভব হয়েছিল। বাধ্য হয়ে বিদেশে বসবাস করলেও তিনি দারুণভাবে অনুভব করতেন 'বঙ্গ ভান্ডারের বিবিধ রতন'।

"হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;– তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি, পর-ধন-লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।" [বঙ্গভাষা, সনেট নং ৩]


পরিণত মনের কাব্য: 'চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী'
'মেঘনাদবধ কাব্য' মধুসূদনের শ্রেষ্ঠ ও ব্যাপক জনপ্রিয় কাব্য হলেও, তাঁর পরিণত মনের কাব্য হলো এই 'চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী'। তাঁর জীবনের বোহেমিয়ানপনা, বেহিসেবি জীবনযাপন, ও অসামঞ্জস্য অর্থসম্পদ খরচের পর এই সনেটগুচ্ছ রচনাকালেই তাঁকে অনেকটা স্থিতধী মনে করা হয়। এখানে তিনি অল্প কথায়, অষ্টক ও ষষ্টক মিলে মাত্র চৌদ্দ মাত্রার চৌদ্দ পঙ্‌ক্তিতে তাঁর ভাবের পূর্ণতা প্রকাশে সক্ষম হন। গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশের দুই সম্পাদক ও ভূমিকা রচয়িতা মনে করেন, সনেটের কঠোর ও দৃঢ় গঠন-গুণে অল্প পরিধির মধ্যে একটি ভাবকে সম্পূর্ণতা দান করার জন্য কবিকে ভাষা সম্বন্ধে অত্যন্ত সজাগ থাকতে হয়েছে, যার ফলে অনেক পঙ্‌ক্তি আজ প্রবাদ বাক্য হয়ে উঠেছে। তাঁর জীবনচরিত রচয়িতা যোগীন্দ্রনাথ বসুও যথার্থই লিখেছেন, "মধুসূদনকে জানিতে হইলে তেমনি তাঁহার চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী পাঠ করিবার প্রয়োজন।"

'চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী' প্রকাশিত হবার পরও মধুসূদন আরও কিছু সনেট রচনা করেছিলেন, যার মধ্যে বিদ্যাসাগর, পরেশনাথ পাহাড়, পুরুলিয়া, পঞ্চকোট গিরি এবং ঢাকা নগরী নিয়ে লেখা সনেটগুলো উল্লেখযোগ্য। ফ্রান্সের ভার্সাই নগরে বসে কবির দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম শেষ বয়সে যতটা প্রকট আকার ধারণ করেছিল, প্রথম জীবনে স্বাদেশিকতা, স্বভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি তিনি ততটাই বিরাগভাজন ছিলেন। তাঁর অমিতব্যয়ী জীবনে বারবার অর্থকষ্টে পতিত হয়েও তিনি তাঁর সৃষ্টি থেকে সামান্যমাত্র পিছু হটেননি। সমাজ ও পরিবারের শৃঙ্খল ভেঙে এক রকম বিদ্রোহ ঘোষণার মধ্য দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, দিন শেষে মনে হয়: মধুসূদন সবকিছুই যেন করেছিলেন কবি হওয়ার জন্য কিংবা সাহিত্যের নতুন ধারা সৃষ্টির জন্য। যে কারণে তাঁর প্রতিটি রচনাই বিশেষভাবে নতুনত্বে ভরপুর। নাটক ও নারী চরিত্রে তিনি যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটান, তা দেখে অনেকেরই চোখ চড়কগাছ হয়ে যায়।

ছোটবেলা থেকে ইংল্যান্ডে গিয়ে বায়রনের মতো কবি হবার স্বপ্ন নিয়ে যে কবির জন্ম হয়েছিল, বাংলায় সেই কবি মাত্র ৪৯ বছরের জীবন কাটিয়ে শুয়ে আছেন কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোডের কবরস্থানে। তিনি আজ বাঙালি পাঠকের কাছে বায়রনের অধিক একক ও স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর, আধুনিক সময়ের প্রথম বিদ্রোহী কবি, সাহিত্যে আধুনিকতা প্রবর্তনের প্রথম প্রবল ব্যক্তিত্ব ও মহামানুষ।

ধ্রুব নিউজের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

💬 Comments

Login | Register
Ad for sale 225 x 270 Position (2)
Position (2)