ধ্রুব নিউজ ডেস্ক
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, বিনোদন সবকিছুতেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত। এর একটি জনপ্রিয় উদাহরণ হলো ওপেনএআই-এর তৈরি চ্যাটজিপিটি, যা প্রাকৃতিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণের একটি উন্নত প্রযুক্তি। এটি ব্যবহারকারীর প্রশ্ন বুঝতে পেরে অর্থপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক উত্তর দিতে সক্ষম, যা সাধারণ চ্যাটবটের নির্দিষ্ট কাজের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথোপকথন পরিচালনা করতে পারে।
চ্যাটজিপিটি এতটাই বাস্তব পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এটি জটিল প্রশ্নের বিস্তারিত ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে বৃহৎ বিষয়ের সারাংশ, গল্প, কবিতা, নিবন্ধ, প্রোগ্রাম, ই-মেইল এবং জটিল অঙ্কের সমাধানও করতে পারে। এমনকি কাদার মধ্যে গরু-মহিষ আটকা পড়লে বা রান্না করা মাংসে লবণ বেশি হলে কী করতে হবে, তার মতো দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানও দিতে পারে। চ্যাটজিপিটি ছাড়াও একই ধরনের 'লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল' ব্যবহার করে এমন আরও অনেক এআই পরিষেবা বিদ্যমান, যাদের নিজস্ব সবলতা ও দুর্বলতা রয়েছে। তবে, অপ্রয়োজনীয় কিছুর জন্যও এআইয়ের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা উদ্বেগের কারণ হতে পারে, যা স্বাভাবিক চিন্তা করার আগ্রহকে ব্যাহত করতে পারে।
শিক্ষাক্ষেত্রে চ্যাটজিপিটির প্রভাব: সুবিধা ও অসুবিধা
শিক্ষাক্ষেত্রে চ্যাটজিপিটির প্রভাব ব্যাপক। এটি শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত চাহিদা অনুযায়ী তথ্য অনুসন্ধানে সহায়তা করে এবং তাৎক্ষণিক ও বিভিন্ন আঙ্গিকের ব্যাখ্যা প্রদান করে। বিশেষ করে, বিদেশি ভাষায় মানসম্পন্ন লেখা (যেমন একাডেমিক প্রতিবেদন, থিসিস, ই-মেইল) লিখতে গিয়ে বানান, ব্যাকরণ বা গঠনগত ভুল সংশোধনে এটি ব্যক্তিগত পরামর্শকের ভূমিকা রাখতে পারে।
শিক্ষার্থীরা নিজেদের মতো করে প্রশ্ন করতে পারে এবং তাৎক্ষণিক উত্তর ও ব্যাখ্যা পেতে পারে। তথ্য অনুসন্ধানে সময় বাঁচে। ইংরেজি লেখালেখি ও বলার জড়তা কাটাতে চ্যাটজিপিটি সহায়ক। এটি লেখার ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়, বাক্য গঠন ও শব্দচয়ন উন্নত করার পরামর্শ দেয়। চ্যাটজিপিটির সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে ইংরেজিতে কথা বলার অনুশীলন করা যায়, যা শব্দভান্ডার বৃদ্ধি ও ব্যাকরণ শেখার সুযোগ করে দেয়।আইইএলটিএস, বিসিএস বা অন্যান্য চাকরির ইন্টারভিউয়ের প্রস্তুতিতে এটি মক টেস্ট ও নমুনা উত্তর দিয়ে সহায়তা করে।
অ্যাসাইনমেন্ট বা বাড়ির কাজ সরাসরি এআই থেকে কপি-পেস্ট করলে শেখার উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় এবং এটি নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য।
চ্যাটজিপিটির উত্তর সবসময় সঠিক হয় না এবং ক্ষেত্রবিশেষে এটি আত্মবিশ্বাসের সাথে ভুল তথ্য দিতে পারে। তাই এর থেকে পাওয়া তথ্যের নির্ভুলতা ও উৎস যাচাই করা অপরিহার্য। এটি মানুষের মতো সৃজনশীল বা নতুন কিছু উদ্ভাবনের সক্ষমতা রাখে না।
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও সহপাঠীদের সাথে যে সামাজিক মিথস্ক্রিয়া হয়, তা শিক্ষার্থীদের সামাজিক ও মানসিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য, যার বিকল্প এআই হতে পারে না। দলগত কাজ এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার মতো দক্ষতা এআই শেখাতে পারে না।
চ্যাটজিপিটির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা, সৃজনশীলতা এবং 'ক্রিটিক্যাল থিংকিং'-এর সুযোগ নষ্ট করে দিতে পারে। প্রকাশনা বা গবেষণার ক্ষেত্রে সরাসরি এআই-সহায়তা নিষিদ্ধ থাকতে পারে, যা অতিরিক্ত নির্ভরশীলদের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে।
চ্যাটজিপিটি ছাড়াও আরও অনেক এআই টুলস শিক্ষা ও কর্মজীবনকে সহজ ও আধুনিক করতে সাহায্য করছে:
· ১. প্রেজেন্টেশন তৈরি: গামা এআই টুল বা ক্যানভা (Canva.com) মতো এআই টুলস ব্যবহার করে সহজে প্রেজেন্টেশন তৈরি করা যায়, যা ব্যবহারকারীকে কনটেন্ট সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও গবেষণায় বেশি সময় দিতে সাহায্য করে।
· ২. ক্লাসওয়ার্ক, হোমওয়ার্ক ও অ্যাসাইনমেন্ট: চ্যাটজিপিটি বা জেমিনির মতো এআই টুলস লেখার বিন্যাস, তথ্য অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণে সহায়তা করে। এক্সামএআই (examai.ai) শিক্ষার্থীদের জন্য কুইজ, ফ্ল্যাশকার্ড ও স্টাডি গাইড তৈরি করে। ক্যাকটাস এআই (caktus.ai) রচনা, থিসিস, কোড লিখতে ও গবেষণাপত্রের সারাংশ তৈরিতে সাহায্য করে। তবে কপি-পেস্ট থেকে বিরত থাকা উচিত এবং রেফারেন্স যাচাই করা প্রয়োজন।
· ৩. বানান ও ব্যাকরণ পরীক্ষা: গ্রামারলি ও কুইলবট মতো টুলস বানান, ব্যাকরণ ও বাক্য গঠন ঠিক করতে সাহায্য করে। এগুলো লেখার মান উন্নত করতে ও আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সহায়ক।
· ৪. পিডিএফ ব্যবস্থাপনা: চ্যাটপিডিএফ ব্যবহার করে বড় পিডিএফ ফাইল বা গবেষণাপত্রের সারাংশ দ্রুত জেনে নেওয়া যায়।
· ৫. ভিডিওর ট্রান্সক্রিপ্ট ও বিশ্লেষণ: অটার ডট এআই বা গুগল নোটবুকএলএম ভিডিও লেকচার বা পডকাস্টের লিখিত ট্রান্সক্রিপ্ট তৈরি করে, যা নোট নেওয়া ও তথ্য খুঁজে পেতে সুবিধা দেয়।
· ৬. সিভি তৈরি: জেটি ডটকম বা রেজুমে ডটআইও এর মতো এআই টুলস পেশাদার ফরম্যাটে সিভি তৈরি করতে সাহায্য করে, যা চাকরির বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরার নির্দেশনাও দেয়।
· ৭. গবেষণা: ইলিসিট প্রাসঙ্গিক গবেষণাপত্র খুঁজে দেয় এবং রিসার্চরবিট রেফারেন্স ম্যাপ করতে সহায়তা করে, যা গবেষণা প্রক্রিয়াকে সহজ করে।
· ৮. কথা থেকে লেখা তৈরি: স্পিচনোটস মুখের কথা বা রেকর্ডকৃত অডিওকে লিখিত আকারে রূপান্তর করতে পারে।
· ৯. ছবি ও ইনফোগ্রাফ তৈরি: ক্যানভা অ্যাডোবি ফায়ারফ্লাই বা মিডজার্নি -এর মতো টুলস ব্যবহার করে অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রেজেন্টেশনের জন্য পোস্টার, চার্ট বা ইনফোগ্রাফিকস তৈরি করা যায়।
· ১০. দলীয় কাজ: নোশন এআই একটি প্রোডাক্টিভিটি টুল যা নোট নেওয়া, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, দলীয় কাজকে সহজ করে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে লেকচার ও স্টাডি ম্যাটেরিয়ালের সারাংশ তৈরি করে।
সবশেষে বলা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষাক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে, যদি এটিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়। এটি মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিকল্প নয়, বরং দক্ষতা উন্নয়নে একটি কার্যকর 'গাইড' হিসেবে এর ব্যবহার সবচেয়ে ফলপ্রসূ।