সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
Ad for sale 100 x 870 Position (1)
Position (1)

পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার শেষ যুদ্ধ: একটি ট্র্যাজিক অধ্যায়

ধ্রুব নিউজ ডেস্ক ধ্রুব নিউজ ডেস্ক
প্রকাশ : মঙ্গলবার, ২২ জুলাই,২০২৫, ১১:০২ এ এম
পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার শেষ যুদ্ধ: একটি ট্র্যাজিক অধ্যায়


পলাশী, ২৩ জুন ১৭৫৭ সাল। এই দিনটি শুধু বাংলার ইতিহাসে নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসেও এক সন্ধিক্ষণ। ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত পলাশীর বিস্তীর্ণ প্রান্তরে তৎকালীন বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ-এর বাহিনীর মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধ, যা ভারতের ভবিষ্যৎ গতিপথ চিরতরে বদলে দিয়েছিল। এই যুদ্ধের ফলস্বরূপ বাংলার স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয় এবং ইংরেজ শাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়।

আজ ২৬৮ বছর পর, কলকাতা থেকে এনএইচ ১২ ধরে মুর্শিদাবাদের দিকে এগোলে পলাশী আজও তার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও ভাগীরথী নদী এখন অনেকটা দূরে সরে গেছে এবং ঐতিহাসিক আমবাগানও আর বোঝার উপায় নেই, তবুও স্মৃতিসৌধ আর স্থানিক জনশ্রুতি এই প্রান্তরের রক্তাক্ত ইতিহাসকে জীবন্ত রেখেছে। স্থানীয়দের কাছে 'তিন গম্বুজ' নামে পরিচিত স্মৃতিসৌধটি আসলে নবাবের তিন বিশ্বস্ত সেনাপতি মীর মদন, বাহাদুর আলি খান আর নুয়ে সিং হাজারি-এর স্মরণে নির্মিত, যারা ১৭৫৭ সালের সেই যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী 'কাণ্ডারি হুঁশিয়ার' কবিতার ছত্রগুলো আজও এই প্রান্তরের ট্র্যাজেডিকে স্মরণ করিয়ে দেয়: "কাণ্ডারি! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর, বাঙ্গালির খুনে লাল হ'ল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর! ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।"

যুদ্ধের প্রেক্ষাপট: ক্ষমতা ও ষড়যন্ত্রের জাল
পলাশীর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট আসলে কয়েক দশক ধরেই তৈরি হচ্ছিল। অধ্যাপক রজত কান্ত রায় তার 'পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ' বইতে উল্লেখ করেছেন যে, আলিবর্দি খানের শাসনামল থেকেই মনসবদার, জমিদার, সওদাগর এবং বিদেশি কোম্পানিগুলো, বিশেষ করে কলকাতার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, মুর্শিদাবাদের দরবারে ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে উঠছিল। আলিবর্দি খান তার প্রতিভাবলে এই সব শক্তিকে বশে রাখতে পারলেও, তার নাতি সিরাজউদ্দৌলা মসনদে বসেই এই সব 'কায়েমী স্বার্থের' ওপর নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এর ফলস্বরূপ, পলাশীর যুদ্ধের কিছুদিন আগেই নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা দখল করে নিয়েছিলেন, যা ব্রিটিশদের ক্ষুব্ধ করে তোলে।

তবে রজত কান্ত রায় মনে করেন, "নতুন নবাবের গণনায় ভুল হলো।" তৎকালীন মাদ্রাজ থেকে ব্রিটিশ বাহিনী কলকাতা পুনর্দখল করতে আসে। এই বাহিনী ছিল কোম্পানির নয়, বরং রয়্যাল আর্মি, যা ফ্রান্সের সঙ্গে ইংল্যান্ডের সপ্ত বর্ষের যুদ্ধের কারণে ভারতে অবস্থান করছিল। এই পরিস্থিতিতে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল আরও বিস্তৃত হয়।

বিশ্বাসঘাতকতার আখ্যান: মীর জাফর ও অন্যান্যরা
পলাশীর যুদ্ধের মূল চরিত্রদের মধ্যে অন্যতম হলেন মীর জাফর। তার নাম বাংলা ভাষায় বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে। সিরাজের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে মীর জাফর ছাড়াও ছিলেন জগৎ শেঠদের মতো ধনিক শ্রেণী এবং কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের মতো সামন্ত প্রভুরা।

অধ্যাপক রজত কান্ত রায় ও বিষাণ কুমার গুপ্তের বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে, যুদ্ধের দুদিন আগে ২১শে জুন, ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার বিরাট বাহিনী নিয়ে মুর্শিদাবাদের মতিঝিল থেকে পলাশীর দিকে রওনা হন। এই বাহিনীতে ৫০ হাজার সৈন্যের কথা প্রচলিত থাকলেও, ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায়ের মতে প্রকৃত সংখ্যা ছিল অনেক কম। মীর জাফর ও রায় দুর্লভের প্রায় ১৩ হাজার সৈন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে কেবল দাঁড়িয়েছিলেন। মীর জাফর কোরআনে হাত রেখে নবাবের বিরুদ্ধে না যাওয়ার শপথ নিলেও, তিনি যুদ্ধে নিষ্ক্রিয় ছিলেন।

মুর্শিদাবাদের মতিঝিলে এখন রাজ্য সরকারের পর্যটন কেন্দ্র থাকলেও, ২৬৮ বছর আগে এই স্থানেই সিরাজউদ্দৌলার বাহিনী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। সিরাজউদ্দৌলা হাতির পিঠে চেপে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তার সাথে ছিলেন মীর জাফরও, যাকে যুদ্ধক্ষেত্রে আনতে নবাবকে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল।

যুদ্ধের দিন ও সিরাজের পতন
২৩শে জুন, ১৭৫৭ সালে দুই বাহিনী পলাশীর প্রান্তরে মুখোমুখি হয়। এয়রে কোতের মানচিত্র থেকে বোঝা যায়, নবাবের বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ক্লাইভের থেকে অনেক গুণ বেশি ছিল। তবে মীর জাফরের নিষ্ক্রিয়তা এবং অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের ভূমিকা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

পরাজয় অবশ্যম্ভাবী টের পেয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলা সেদিনই নিজের রাজধানী মুর্শিদাবাদের দিকে উটের পিঠে চেপে রওনা হন এবং হীরা ঝিলের প্রাসাদে ফিরে আসেন। তার ইচ্ছা ছিল মুর্শিদাবাদ ছেড়ে রাজমহলের দিকে গিয়ে ফরাসিদের সাথে যুক্ত হয়ে পুনরায় ফিরে আসা। কিন্তু পথেই তিনি ধরা পড়ে যান এবং তাকে ফিরিয়ে আনা হয় মুর্শিদাবাদে, মীর জাফরের প্রাসাদে বন্দি করে রাখা হয়।

কয়েকদিন বন্দি থাকার পর ২রা ও ৩রা জুলাই মধ্যরাতে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করা হয়। লালবাগ কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক ফারুক আবদুল্লা জানান, "তার দেহকে বহু খণ্ডে টুকরো টুকরো করা হয় এবং তার আগে তাকে অত্যাচারও করা হয়। তার দেহকে কয়েক খণ্ডে বিভক্ত করা হয় এবং সেই দেহখণ্ডগুলো বস্তায় ভরে হাতির পিঠে চড়িয়ে গোটা মুর্শিদাবাদ শহর ঘোরানো হয়েছিল।" এরপর সিরাজউদ্দৌলার দেহখণ্ডগুলো গঙ্গার পশ্চিম তীরে তার পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রে, খোসবাগে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তিনি শায়িত আছেন।

পলাশীর যুদ্ধ শুধু একটি সামরিক সংঘাত ছিল না, এটি ছিল একটি গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ফল, যা বাংলার স্বাধীনতাকে হরণ করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। এই যুদ্ধ ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

 

ধ্রুব নিউজের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

💬 Comments

Login | Register
Ad for sale 225 x 270 Position (2)
Position (2)